
যা সত্য তাই লিখেছি, প্রত্যাহার করব না
২৭ জুলাই দৈনিক আমাদের অর্থনীতিতে ‘সজীব ওয়াজেদ জয়ের নামে ক্যুৎসা রটানো তো রাষ্ট্রীয় অবদান’ শিরোনামে প্রকাশিত আমার লেখাটির প্রতিবাদ করেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, অস্ট্রেলিয়ার সভাপতি সিরাজুল হক ও সাধারণ সম্পাদক পি এস চুন্নু। লেখার সঙ্গে কেউ ভিন্নমত পোষণ বা প্রতিবাদ করলে আমি সচরাচর এর জবাব দিই না। তার উপর এখন আগস্ট মাস, ভীষণ কষ্টের-শোকের স্পর্শকাতর একটা মাস। এ রকম সময়ে নিজের সামান্য লেখা নিয়ে বাদ-প্রতিবাদ মোটেও সুখকর কিছু নয়। আমি খুশি হতাম, জুলাই মাসে প্রকাশিত লেখার প্রতিবাদ যদি তারা ওই মাসেই পাঠাতেন। তবু ব্যাখ্যা প্রদান করছি, যেহেতু সিরাজুল হক এবং পি এস চুন্নু ওরফে প্রদ্যুত সিং চুন্নু আমার লেখাটাকে ‘সম্পূর্ণ বানোয়াট, মনগড়া এবং লেখায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বেশকিছু তথ্য উপস্থাপন করার অপচেষ্টার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বিরূদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করা হয়েছে’ দাবি করে প্রত্যাহার করে নিতে বলেছেন, অন্যথায় অস্ট্রেলিয়ায় আমার বিরূদ্ধে আদালতের স্মরণাপন্ন হবার হুমকি দিয়েছেন, সেহেতু নিজের ব্যাখ্যা দেওয়াটা জরুরি মনে করছি।
প্রতিবাদের দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফের শুরুতেই অসত্য তথ্য। লিখেছেন, ‘উল্লেখিত লেখায় আবুল হাসনাৎ মিল্টন দাবি করেছেন, তিনি দীর্ঘদিন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন।’ অথচ আমরা লেখাটি বারবার পড়ে কোথাও ‘ছাত্রলীগ’ শব্দটাই খুঁজে পেলাম না, ছাত্রলীগের সঙ্গে আমার সম্পর্কতো অনেক দূরের ব্যাপার। এর পরেই লিখেছেন, ‘আমাদের জানা মতে, তিনি অস্ট্রেলিয়ায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করলেও কখনও তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।’ এই তথ্যটি যে শুধু মিথ্যে তাই-ই নয়, এর মধ্য দিয়ে তাদের স্বভাবের কৃতঘœতার দিকটাও দৃষ্টিকটুভাবে ফুটে উঠেছে। বেশি দূর যেতে হবে না, সিডনিতে আওয়ামী লীগের গত দুবছরের জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানের জন্য আমার প্রাক্তন ছাত্রকে অনুরোধ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার থিয়েটার বিনা ভাড়ায় যোগাড় করে দিয়ে, সেমিনারের টপিক ঠিক করে, মূল প্রবন্ধ লিখে ও পাঠ করে, অনুষ্ঠানের ছবি তুলে, ঢাকার পত্রিকায় প্রেসরিলিজ লিখে পাঠিয়ে দিয়ে আমি কি তাহলে ভুলই করেছিলাম? আমার আইফোনের মেসেজ বক্স কতকিছুর সাক্ষী। আওয়ামী লীগের যেকোনো প্রয়োজনে কতবার যে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ফোন করেছেন, তা নিশ্চয়ই টেলিফোনের কললিস্ট ঘাটলে খুঁজে পাওয়া যাবে। প্রতিবারই আমি সম্ভব হলে আওয়ামী লীগের প্রয়োজনে নিঃস্বার্থভাবে তাদের কাজ করে দিয়েছি।
অস্ট্রেলিয়ায় আছি চৌদ্দ বছরের বেশি। ক্যানবেরায় পিএইচডি অধ্যয়নকালীন, পরবর্তীতে নিউক্যাসেল এসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের এমন কোনো প্রয়োজনের মুহূর্ত ছিল না যখন দূরে সরে থেকেছি। ওয়ান ইলেভেনের সময় জননেত্রী শেখ হাসিনাকে যখন গ্রেফতার করা হলো, তখন নিউক্যাসেল থেকেই আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের সকল অংশের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করে সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ সভা আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছি। সারা অস্ট্রেলিয়া তন্ন তন্ন করে খুঁজে সে সময়ের ঊনচল্লিশজন প্রাক্তন ছাত্রলীগার-চিকিৎসকের সম্মতি ও স্বাক্ষর যোগাড় করে শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে ঢাকার পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছি। সে সময়ে সাংবাদিক ফজলুল বারী ঢাকার মিডিয়ায় প্রচারের অনেক সাহায্য করেছেন। ঢাকা থেকে ২০০৭ এর ১১ মে সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমান যখন নাঈমুল ইসলাম খান সম্পাদিত দৈনিক আমাদের সময়-এ মাইনাস টু ষড়যন্ত্রের পক্ষাবলম্বন করে দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য কলাম লিখেছেন, তখন পরেরদিন ১২ মে সেই লেখার প্রতিবাদ করে ওই পত্রিকাতেই কলাম লিখেছিলাম। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের অবরুদ্ধ বাংলাদেশে অস্ট্রেলিয়া থেকে এভাবে দেশ ও দলের পক্ষে একের পর এক প্রতিবাদী কলাম লিখে গেছি। প্রবাসে বসে এটা ছিল আমাদের এক ধরনের আন্দোলন। সে সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা, অধ্যাপক মোদাচ্ছের আলী এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি নিয়মিত নিউক্যাসেলে ফোন করে আন্দোলনের ব্যাপারে পরামর্শ দিতেন। মাঝে মধ্যে ই-মেইলে স্নেহাস্পদ লিয়াকত শিকদার, মাহবুবুল হক শাকিলও যোগাযোগ করতেন। এমন কি নেত্রীর মুক্তিলগ্নে ২০০৮ সালের ১৩ জুন সজীব ওয়াজেদ জয় আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘দিস হ্যাজ বিন পসিবল বিকজ অব দ্য সাপোর্ট অব পিপল সাচ অ্যাজ ইউ’। বছর সাতেক আগে এক ভরা মজলিশে বিশিষ্ট সাংবাদিক সৈয়দ বোরহান কবীর আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই ছেলেটা এমন নিঃস্বার্থভাবে দলের জন্য কাজ করে!’ যারা আমাকে খুব কাছে থেকে জানে, তারাও অনেকবার এই সত্যটা স্বীকার করেছেন।
গত প্রায় দেড় দশক অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানকালীন দেশের জন্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, আওয়ামী লীগের জন্য, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্তর্জাতিক মতামত গঠনের লক্ষ্যে, দেশের মেডিকেল শিক্ষা ও স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে আমার ভূমিকার পুরোটা না হোক, আংশিকতো সিরাজুল হক আর প্রদ্যুত চুন্নুর জানা থাকার কথা। তবু চেনা বামুনের কাছে যখন পৈতা চাইছেনই, তখন দুজনের কাছে খুব জানতে ইচ্ছে করে, ‘আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার সংজ্ঞাটা’ তাদের কাছে আসলে কী?
ছাত্রলীগের সঙ্গে আমার সম্পর্ক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢামেকসু ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে নব্বইয়ের গণ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব প্রদান, এসবই ইতিহাসের অংশ। একানব্বইয়ের ২৮ মার্চ ছাত্রদলের ক্যাডাররা অস্ত্রের মুখে আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল, পরবর্তীতে জাতীয় সংসদে বক্তৃতায় শেখ হাসিনা আমার নাম উল্লেখ করে সেই হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদ করেছিলেন। তখন বয়সে তরুণ হলেও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলাম। তারপরও মানুষের কাছে যেচে পড়ে নিজের রাজনৈতিক অতীত নিয়ে কথা বলতে যাই না। দল ক্ষমতায় গেলে কিছু একটা পেতেই হবে, এই ধারণায় আমি বিশ্বাসী নই। নিজে এত বছর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, মন্ত্রী পরিষদে এত পরিচিত মুখ, তাও ব্যক্তিস্বার্থে কোনো নেতার কাছে কোনোদিন হাত পাতিনি। তবু একবার, ১৯৯৩ সালে কীভাবে যেন হাসিনা আপা জানলেন, ২৯ মিন্টো রোডের বিরোধীদলীয় নেত্রীর বাড়িতে দোতলায় ওঠার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীরে, সিরাজ ভাই নাকি মেয়ে দেবে না? তুই বিয়ে করে সোজা আমার বাসায় নিয়ে আয়’। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ সান্নিধ্য পাইনি, রাজনীতি করতে গিয়ে শেখ হাসিনার স্নেহের সান্নিধ্য পেয়েছি। এক জীবনে এ এক বিশাল প্রাপ্তি, এর কাছে বৈষয়িক সব প্রাপ্তি ম্লান হয়ে যায়। এটা হয়তো সিরাজুল হক বা প্রদ্যুত চুন্নুদের কল্পনারও বাইরে।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন সৈনিক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয় আমাদের কাছে এক আবেগের নাম। সেই জয় সম্পর্কে মিথ্যে ক্যুৎসা রটনা করে কেউ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকবে, ‘রাষ্ট্রের প্রতি অবদানের’ কোটায় ঢাকায় প্লট পাবে এটা মেনে নিতে স্বভাবতই কষ্ট হয়। তাই আমি প্রতিবাদ করেছি। আমি সুনির্দিষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতেই ‘আওয়ামী লীগের অস্ট্রেলিয়া শাখার কোষাধ্যক্ষ সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে ক্যুৎসা রটিয়েছেন’ লিখেছি। এই ব্যক্তিই জাতীয়তাবাদী যুবদল, অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষ নেতা হতে চেয়েছিলেন, সেটাও আমি নিশ্চিত হয়েই লিখেছি। এমন কি, আমার লেখার প্রতিবাদ প্রকাশিত হওয়ার পরও আমার লেখায় উল্লেখিত তথ্যসমূহের সত্যতা পুনর্বার নিশ্চিত করেছি। সুতরাং, উপরোল্লিখিত প্রেক্ষিতে আমি আমার লেখাটি প্রত্যাহার করতে পারছি না বলে সিরাজুল হক ও প্রদ্যুত চুন্নুর কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি। এরপর যদি তারা অস্ট্রেলিয়ায় আমার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে চান, তারা নিতেই পারেন। তবে অচিরেই আমার লেখার স্বপক্ষে সমস্ত প্রমাণাদি আমি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে পৌঁছে দেব।
লেখক : অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী, কবি ও চিকিৎসক / সম্পাদনা : জব্বার হোসেন
