বেলুচিস্তান নিয়ে মোদির মন্তব্যে পাকিস্তানের দুশ্চিন্তা
মালিক সিরাজ আকবর : ভারতের স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বেলুচিস্তানের নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। যারা বিশ্বাস করেন তাদের বলছি, নিশ্চয় মোদির মন্তব্য কোনো দুর্ঘটনা নয়। তিনি সম্ভবত ভারতের নতুন নীতি নিয়ে কথা বলছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা দিবসে দেওয়া মোদির ওই বৈরি বক্তব্যে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে। একইসঙ্গে মোদির এই বক্তব্য আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার উপর প্রভাব পড়বে।
ইসলামাবাদ ইতিমধ্যে মোদির ওই বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে নিশ্চিত হয়েছে বেলুচিস্তানে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রিত গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড এনালাইসিস উইংস (র) এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তারাই বেলুচিস্তানে কলকাঠি নাড়ছেন। বেলুচিস্তানের অধিকাংশ নেতা ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পাকিস্তানের সরকারের বিরুদ্ধে যে ঘোষণা দিয়েছেন তা স্বাগতম জানিয়েছেন।
পাকিস্তানের সব নাগরিক মনে করেন বেলুচিস্তান পাকিস্তানের অংশ। তাই বেলুচিস্তান পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’। বেলুচিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তান ও ইরানের সীমান্ত রয়েছে। তালেবান, আইএস ও আরও অন্যান্য সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সংঘবদ্ধ হয়ে পাকিস্তান, ইরান ও আফগানিস্তানসহ এই অঞ্চলে সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা করছে।
বেলুচিস্তানের সশস্ত্র গোষ্ঠী একই ধর্মীয় জাতি হওয়া সত্ত্বেও সন্ত্রাসীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছে না। তারা সরকারি কর্মকর্তাদের টার্গেট করে আক্রমণ করছে। বেলুচিস্তানে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করাই তাদের প্রথম অগ্রাধিকার।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার বেলুচিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ড. আব্দুল মালিক বালুচ ছাড়া এখনো আন্তরিকতার সঙ্গে বেলুচিস্তানের নির্বাসিত নেতাদের সঙ্গে আলোচনার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। মালিক ইউরোপ ভিত্তিক নির্বাসিত নেতা খান অব কালাত নামে পরিচিত ও ব্রাহামদা বুগতির সঙ্গে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে বুগতি ইচ্ছাকৃতভাবে পাকিস্তানের সরকারের সঙ্গে সমঝোতার প্রস্তাব দেন। তবে ইসলামাবাদ ব্রাহামদা বুগতির প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে না। কারণ এই নেতা একটি সাক্ষাৎকারে বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন চেয়েছেন। বেলুচিস্তানের সংকট একটি বৈঠকেই সমাধান করা সম্ভব নয়। তারা একে অপরের সঙ্গে কথা বলবেন। শলাপরামর্শ করবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত উইন-উইন অবস্থার সৃষ্টি না হয়। এই জন্য অনেক সময় লাগতে পারে। কয়েক মাস ও কয়েক বছরও লাগতে পারে।
এর মধ্যে বেলুচিস্তানের কিছু নেতা মোদির বক্তব্যকে স্বাগতম জানিয়েছেন। তাদের এমন আচরণে আমি অবাক হয়েছি। তারা আসলে কি চায়? একদিকে পাকিস্তানের সরকারের সঙ্গে আলোচনা চাচ্ছেন অন্যদিকে মোদির বক্তব্যকে স্বাগতম জানাচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে বেলুচিস্তানের নাগরিকরা ইসলামাবাদের প্রতি অসন্তোষ এটি সত্য। তবে মোদির মতো মানবতা বিরোধী অপরাধীর কথায় কিভাবে সম্মতি প্রকাশ করলেন। গুজরাটে সহিংসতার জন্য মোদি দায়ী। এছাড়া কাশ্মীরে শত শত নীরিহ প্রতিবাদীদের উপর মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী।
বেলুচের নাগরিকরা তাদের ধর্মীয় নিরপেক্ষতার জন্য গর্ব বোধ আগে থেকেই করে আসছে। যেখানে মোদি বেলুচিস্তানের ধর্মীয় নিরপেক্ষতা ও বাকস্বাধীনতার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মোদি কট্টর হিন্দুদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তার নেতৃত্বে ভারতে ধর্মান্ধতা ও অসহিষ্ণুতা বেড়ে যাচ্ছে।
বেলুচিস্তানে যে আন্তর্জাতিক সমর্থনের কথা বলা হচ্ছে তা ব্যক্তিগত। এমন কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি বা সংগঠন আন্তর্জাতিক সমর্থন চায়নি। ব্যক্তিগতভাবে যে আন্তর্জাতিক সমর্থন চেয়েছে তা সাময়িক। পাকিস্তানের সরকার বেলুচিস্তানের হার্ডলাইনার ও মডারেটদের অভ্যন্তরীণ সহিংসতায় কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করেনি। কারণ গত সপ্তায় আন্দোলনকারীরা বিভাজন হয়ে পড়েছেন।
আলোচনা না হওয়ায় বেলুচিস্তান ও ইসলামাবাদের মধ্যে সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। দুই পক্ষকেই মনে রাখতে হবে ভুল সিদ্ধান্ত ও ভুল কর্মকা- বেলুচিস্তানের সাধারণ মানুষের মধ্যে ট্রাজেডি নিয়ে আসবে। গত এক যুগ ধরে কি ঘটেছিল তা উভয় পক্ষকে ভুলে যেতে হবে। বেলুচিস্তানের বিদ্রোহীরা ভারতের সমর্থনে আঞ্চলিক অশান্তি বাড়াতে পারে। তাই বেলুচ নাগরিকদের ইসলামাবাদের মধ্যে টানাপোড়েনের ইতি টানতে হবে। আমরা আশা করি শিগগরই তার পরিসমাপ্তি ঘটবে।
ইসলামাবাদকে মোদির বক্তব্যের গুরুত্ব বুঝে পদক্ষেপ নিতে হবে। মোদি যা বলেছেন যদি তা করতে পারেন তবে সরকারের আর সময় নষ্ট করা উচিৎ হবে না। এক দশক ধরে সামরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে কোনো কার্যকরি ফল আসেনি বেলুচিস্তানে। এখন সময় এসেছে বেলুচিস্তানের সংকট নিরসনে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করার।
হতাশার মধ্যেও বেলুচিস্তান নিয়ে পাকিস্তানকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত আর কালক্ষেপণ না করে ‘র’ বেলুচিস্তানে যে সংকট তৈরি করছে তার প্রতিরোধ করে তোলা। কৌশল অবলম্বন করে বেলুচিস্তানে টেনশন রোধ করা সম্ভব। বেলুচ নেতাদের আলোচনার টেবিলে বসিয়ে সংকটের সমাধান করতে হবে।
লেখক: ওয়াশিংটন ডিসি ভিত্তিক থিংক ট্যাংক বেলুচিস্তান ইন্সটিটিউটের প্রেসিডেন্ট ও সিইও। ডন থেকে অনুবাদ: এম রবিউল্লাহ