
তারা কেন আমাদের ঘৃণা করে?
ফরিদ জাকারিয়া : পরবর্তী সময়ে আপনি হয়তো একটি সন্ত্রাসী হামলার কথা শুনে থাকবেন। আর সেটা যেখানেই হোক না কেন বা যে পরিস্থিতিই হোক না কেন। আপনি সম্ভবত মনে করবেন, মুসলিমরা আবারও হামলা করেছে। আর হয়ত আপনার ধারণাই সঠিক হবে।
২০১৪ সালে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী হামলায় প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। এসব সহিংসতাকারীদের বেশিরভাগই মুসলিম। তবে এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে, ভুক্তভোগীদেরও বেশিরভাগ মুসলিম। নিহত ত্রিশ হাজারের বেশিরভাগই মুসলিম।
এটা বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এটা একটি প্রশ্ন তুলে ধরেছে। তা হলো ‘কেন তারা আমাদের ঘৃণা করে?’ ইসলামি সন্ত্রাসীরা কেবল আমেরিকা বা পশ্চিমাদের ঘৃণা করে না। তারা আধুনিক বিশ্বকে ঘৃণা করে। বিশেষ করে তারা যেসব মুসলিম আধুনিক বিশ্বে বসবাস করার চেষ্টা করছেন তাদের ঘৃণা করে।
চলুন বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া যাক। জিহাদিরা যদিও গুটি কতেক। কিন্তু তারা মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি বিশাল ক্যান্সার। এটা পশ্চাৎপদতা, উগ্রপন্থা এবং অসহনশীলতার ক্যান্সার। যেসব রাষ্ট্রে এমন আইন আছে যা ধর্ম চর্চার স্বাধীনতা সীমিত করে, সেসব দেশের অধিকাংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। অন্যদিকে যেসব দেশের বিশ্বাস ত্যাগের বিরুদ্ধে আইন আছে সেগুলো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ।
কিন্তু এসব বিষয় কি ধর্মে অর্šÍভুক্ত আছে?
১৪ শতকে বিশেষজ্ঞরা যখন এটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন তখন ইসলামি সভ্যতা বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রগামী সভ্যতা ছিল। অথবা তখন কুরআনকে একটি উদার ও প্রগতিশীল নথি হিসেবে পড়া হতো। আর আজ তারা পশ্চাৎপদতার বাস্তবতা অস্বীকার করার চেষ্টা করছেন না। তারা যা বলছেন, সেটা এর পরিবর্তন হতে পারে।
মোটের উপর ইসলাম প্রায় ১৪ শতক পার করেছে। এখানে যুদ্ধ ও শান্তির অনেক সময় পার হয়েছে। ১৯০০ সালের আগে কয়েকশ বছর যাবৎ ইহুদিরা ইউরোপীয় হত্যা-গণহত্যা ও নির্যাতন থেকে বাঁচতে অপেক্ষাকৃত শান্তি ও নিরাপদ উসমানিয়া খেলাফতের অধীনে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করে। আর এ কারণেই ১৯০০ সালে মুসলিম অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্যে এক মিলিয়ন ইহুদি জনসংখ্যা ছিল। আজ ইহুদি ও খ্রিস্টানরা ইরাক ও সিরিয়া থেকে পলায়ন করছে এবং উগ্রবাদী মুসলিমরা এসব ভূখ-ের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। অথচ তখন এবং এখন সেখানে একই ধর্ম রয়েছে।
তাহলে প্রশ্ন ভিন্ন কি রয়েছে?
এটা ধর্মতত্ত্ব নয়। এটা রাজনীতি। উগ্রবাদী ইসলাম মুসলিম দেশগুলোর ভাঙা রাজনীতি ও স্থবির রাজনীতির পণ্য। তারা মৌলবাদী ধর্মে একটি মতাদর্শ খুঁজে পেয়েছেন যা তাদের আধুনিক বিশ্বের বিরুদ্ধে ঠেলে দিচ্ছে। এটা এমন এক আদর্শ যা ইউরোপের সব জায়গার তরুণ মুসলিমদের বিচ্ছিন্ন করে রাখতে এখন রপ্তানি করা হচ্ছে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও একই ধরনের কিছু বিরল ঘটনা ঘটছে।
আমরা কিভাবে এর অবসান আনতে পারি?
বাস্তবিকপক্ষে এখানে মাত্র একটি উপায় রয়েছে। সেটা হলো উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করা, তাদের বিশ্বাস সংস্কার করা এবং তাদের সমাজকে আধুনিকীকরণ করতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের সাহায্য করা।
আর এমনটা করতে আমাদের উচিত অগ্রভাগে যারা রয়েছে তাদের কথা শুনা। যাদের অনেকে জিহাদিদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন ও প্রাণ হারাচ্ছেন। যখন পশ্চিমা রাজনীতিক ও প-িতরা পুরো ইসলামের নিন্দা করছে, তাদের বিশ্বাসকে ছোট করছে এবং সব মুসলিমকে পশ্চাৎপদ ও সন্দেহভাজন করে চিত্রিত করছে। তখন শত শত মুসলিম সংস্কারকের জন্য এ কাজ আরও কঠিন হবে।
তবে এ সম্পর্কে ভাবনার আরও উপায় রয়েছে। মার্কিন বিচার বিভাগের সমীক্ষা মতে, আমেরিকায় মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ আফ্রিকান-আমেরিকান। বিচার বিভাগে যাদের প্রায় ৫০ ভাগের বিরুদ্ধে নরহত্যার অপরাধে মামলা রয়েছে।
এখন আমাদের বিষয়টি বুঝতে পারার কথা। আমি আশা করি আমরা বুঝতে পেরেছি। কারণ যখন আমরা একজন কালো মানুষকে রাস্তায় দেখি আমরা অবশ্যই তাকে একজন অপরাধী হিসেবে গণ্য করতে পারি না। তাহলে এটা অমানবিক, অন্যায্য ও বর্ণবাদী হিসেবে গণ্য হবে।
আমেরিকার সর্বত্রই মানুষজনকে কেবল একজন ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা উচিত। তাকে একটি বর্ণ, নৃগোষ্ঠী বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করে আচরণ করা উচিত নয়। মনে রেখ বাংলাদেশি ক্যাব ড্রাইভার যে তোমাকে বিমানবন্দরে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তার আইএসের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি সে যদি একজন মুসলিমও হয়।
অবশ্যই দ্রুত এমন সংশ্রব গড়ে তোলা কঠিন। বিশেষ করে একের পর এক সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষিতে এমন পরিবেশ গড়া কঠিন। তবে আমেরিকা যদি কোনো ধারণা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করে, তাহলে এটা একটা ধারণা হতে পারে। যেখানে মানুষকে একজন ব্যক্তি হিসেবে এবং তার ব্যক্তিগত উদারতা ও অধিকার দিয়েই বিচার করা হবে। আর এটাই কারণ, যে কারণে তারা আমাদের ঘৃণা করে। পাশাপাশি আমরা আমাদের নিজস্ব আদর্শ নিয়েই বসবাস করতে পারি। সিএনএন থেকে অনুবাদ করেছেন মমিনুল ইসলাম।
সম্পাদনা : রাশিদ রিয়াজ
