
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা আ.লীগের অভিযোগে বিএনপি নেতারা যা বলেছিলেন
এম কবির ও আমির পারভেজ : ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতারা অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন। তবে আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২২ নেতা-কর্মী নিহত হয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন শতাধিক। অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাদের কেউ কেউ আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি।
ঘটনার গুরুত্ব নষ্ট করতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং বিএনপির সাবেক মহাসচিব ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী আব্দুল মান্নান ভূঁইয়াসহ বিএনপি নেতারা এক পর্যায়ে গ্রেনেড হামলার জন্য আওয়ামী লীগকেই দায়ী করেন। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ- আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে খতম করার জন্যই গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল আওয়ামী লীগই।
ঘটনা তদন্তে হামলার পরদিন ২২ আগস্ট জোট সরকার বিচারপতি মো. জয়নাল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে। সেই কমিশনও নিরপেক্ষভাবে কাজ না করে সরকারের ‘ধামাধরা’ হিসেবে কাজ করতে থাকে। ৪০ দিনের মাথায় কমিশন সরকারের কাছে ১৬২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দেয়।
কমিশনের রিপোর্টে জোরালোভাবে বলা হয়- গ্রেনেড হামলার সঙ্গে একটি শক্তিশালী বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিল। অর্থাৎ কমিশনের অভিযোগের আঙুলও ছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার দিকে। কমিশনের রিপোর্টে সুনির্দিষ্টভাবে গোয়েন্দা সংস্থার নাম বলা হয়নি, অথচ বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা যে জড়িত তা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল। তবে ২০০৪ সালের ৪ অক্টোবর দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে কমিশনের চিফ, বিচারপতি জয়নাল আবেদীন বৃহৎ প্রতিবেশী শক্তি হিসেবে ভারতের প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন।
গ্রেনেড হামলার দুই সপ্তাহ পর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল ওই হামলা সম্পর্কে বিএনপি নেতাদের উদ্দেশে প্রশ্ন আকারে কয়েকটি অভিযোগ করেন। এগুলো হচ্ছে- ‘২১ আগস্ট হত্যাকা-ের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তার জন্য সমাবেশে নিরাপত্তা ব্যবস্থা শিথিল এবং ভবনগুলোর ছাদে পর্যন্ত পর্যাপ্ত পুলিশের উপস্থিতি ছিল না; ২. অন্যান্য সমাবেশের মতো সেদিন আশপাশের ভবনে আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকদের দায়িত্ব পালন করতে দেয়নি পুলিশ; ৩. হামলার পর পরই পুলিশ টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপের মাধ্যমে ঘটনাস্থলে ধোঁয়া ও অন্ধকারের আবরণ সৃষ্টি করে অপরাধীদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়; ৪. ঘটনার পরপর পুলিশ কয়েকজনের লাশ গুম করে; ৫. প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, আইভি রহমানকে দেখতে গেলে তার (আইভি রহমান) পরিবারের সদস্যদের হাসপাতালের একটি কক্ষে তালাবদ্ধ করে রেখে চূড়ান্ত অসৌজন্যতার পরিচয় দেওয়া হয়; ৬. গণহত্যার শিকার নেতাকর্মীদের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তরে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিলম্ব করা হয়; ৭. ঘটনার পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করতে গেলে গ্রহণ করা হয়নি; ৮. ২১ আগস্ট গণহত্যার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাওয়া গ্রেনেডের উৎস কোথায়? ৯. ঘটনাস্থলে উদ্ধারকৃত অবিস্ফোরিত গ্রেনেডগুলোর বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আলামত ও হাতের ছাপ নষ্ট করে দেওয়া হয় এবং ১০. ওই সময় পর্যন্ত সংঘটিত বোমা ও গ্রেনেড হামলার একটিরও লক্ষ্যবস্তুু বিএনপি বা জামায়াত বা তাদের কোনো নেতা হননি। হামলাকারীরা কাদের আশ্রিত- এতেই বুঝা যায়।’
প্রয়াত আবদুল জলিলের প্রশ্নগুলোর সদুত্তর বিএনপি নেতারা তখনো দিতে পারেননি, এখনো দিতে পারবেন না বা দেবেন না।
২ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘সরকারের সাফল্য থেকে জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত করে তোলাই ছিল এই বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় অন্যতম উদ্দেশ্য।’
তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ২০০৪ সালে ১৫ সেপ্টেম্বর সংসদে বলেন, সরকার ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রহস্য উন্মোচন এবং অপরাধীদের চিহ্নিত করার বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়েছে। দেশের ইতিহাসে প্রথমবার কোনো সরকার গ্রেনেড হামলার অপরাধীদের সম্পর্কে তথ্য প্রদানের জন্য ১ কোটি টাকার একটি পুরস্কার ঘোষণা করেছে।’
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার পর এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘শুধু জাতির শত্রুরাই এই ধরনের বর্বরোচিত হামলা করতে পারে।’
বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ২০১১ সালের ২১ আগস্ট এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, ‘বিএনপি সরকারের আমলে জজ মিয়ার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি সত্য ছিল। সম্প্রতি যে সম্পুরক চার্জশিট পেশ করা হয়েছে সেটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।’
তৎকালীন বিএনপির মহাসচিব ও এলজিআরডিমন্ত্রী আবদুল মান্নান ভূঁইয়া হামলার পর এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘এটি বর্বর ও দুঃখজনক ঘটনা। যারাই ঘটিয়েছে তারা মানুষ নয়। তারা গণতন্ত্রের শত্রু, দেশের শত্রু ও জনগণের শত্রু।’
তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ২০০৪ সালের ৩০ আগস্ট এক সমাবেশে বলেছিলেন, ‘২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ এই হামলার তদন্তে সরকারকে সহযোগিতা করতে চায় না।’
তৎকালীন পানিসম্পদমন্ত্রী মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ ২০০৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, ‘তারাই বোমা বিশেষজ্ঞ। তারা কেন বিএনপির দিকে আঙুল দেখায়?’
তৎকালীন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ফজলুর রহমান ২০০৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, ‘২১ আগস্টে শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন আইভি রহমানের মতো আরও বেশি মৃতদের ছবি নিয়ে ছবির গ্যালারি তৈরি করতে। যেমন- তিনি তার সরকারের আমলে তার বাবার হত্যার রায় কার্যকর করেননি ঠিক সেরকমভাবে চেয়েছিলেন এই মৃতদেহের মিছিল নিয়ে ব্যবসা করতে।’
তৎকালীন বিএনপির এমপি মশিউর রহমান ২০০৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সংসদে বলেছিলেন, ‘গ্রেনেড হামলায় আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা সবচেয়ে উপকৃত হয়েছে। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ এত বেশি সহানুভূতি পেয়েছেন তারা, মনে করেছে তারা ইতিমধ্যেই ক্ষমতায় চলে গেছে।’
বিএনপির সংসদ সদস্য শহীদুল ইসলাম ২০০৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, ‘তারা (আওয়ামী লীগ) বোমা নাটক মঞ্চায়ন করে মানুষকে বোকা বানিয়ে ক্ষমতায় যেতে চান। তাদের ষড়যন্ত্র সম্পূর্ণ বানচাল হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার উপযুক্ত নেতৃত্বের কারণে।’
তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২০১১ সালের ২১ আগস্ট এক আলোচনা সভায় বলেছিলেন, ‘বিএনপিকে গ্রেনেড হামলার জন্য দায়ী করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার প্রকৃত অপরাধীদের রক্ষা করতে চায়।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ২০১২ সালের ২৫ আগস্ট বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার দায় বিএনপি’র উপর চাপাতে চায়।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মরহুম কে এম ওবায়দুর রহমান ২০০৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, ‘বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা নিয়ে নিরীক্ষণ করছে। আরও অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তদন্ত সংস্থা তদন্ত করেছে। এতকিছুর পর সরকারের আর কিছু করার নেই।’ সম্পাদনা : রাশিদ রিয়াজ
