ঢাকায় ঢাকা থাকে প্রকৃত বাংলাদেশ
ঢাকায় সবকিছু ঢাকা থাকে। এমনকি ঢাকা থাকে ঢাকাও। আর ঢাকায় থাকতে থাকতে ‘পুরো বাংলাদেশটাকেই’ এক সময় ‘ঢাকা’ মনে হয়। শুধু তাই নয়, তখন দেশের বাকি সব মানুষকে (অন্য সব জাতিগোষ্ঠী) ‘ঢাকাইয়া বাঙালি’ মনে হয়। এই ‘মনে হওয়াটা’ আমার মনগড়া কথা নয়; এটা ঢাকাবাসী যেকোনো দলের প্রধান নেতা বা যেকোনো সরকারের ‘প্রধানমন্ত্রী’ থেকে শুরু করে সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের নেতা-ক্ষেতা, কবি-টবি, লেখক-টেখক, নায়ক-গায়ক, হুজুর-মজুর, বিজ্ঞানী-অজ্ঞানী সবার ক্ষেত্রেই ঘটে। এটাই নির্মম বাস্তবতা। প্রশ্ন: এই বাস্তবতা নির্মম কেন? কারণ, ঢাকা একই সঙ্গে তখন পুরো দেশটাকেই ঢেকে রাখে; ঢেকে রাখে তার অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি; ঢেকে রাখে তার অশেষ মেধার সমগ্র সম্ভাবনাভূমি; ঢেকে রাখে প্রকৃত বাংলাদেশকে।
ঢাকাবাসীর ঢাকাইয়া-মস্তিষ্ক ঢাকার বাইরে কিছু ভাবতেই পারে না। তাই সবই হয় ঢাকাকেন্দ্রিক; আর সবই ঢাকাকেন্দ্রিক হলে পুরো দেশটাই হয়ে পড়ে ‘ফাঁকাকেন্দ্রিক’। আর পুরো দেশটাই যদি ফাঁকাকেন্দ্রিক হয়, তবে সে দেশ, সে জাতি, সত্যিকারের দেশ-জাতি হিসেবে বড় হতে পারে না, বেড়ে উঠতে পারে না; ওই দেশ ওই জাতিও ফাঁকা দেশ, ফাঁকা জাতি হয়ে দাঁড়ায়। আর প্রকৃত অর্থে এটাই হচ্ছে। ঢাকা যে কতকাল ধরে কতকিছু ঢেকে রেখেছে! ঢাকা থাকতে থাকতে কতকাল ধরে কতকিছু যে পেকে গেছে। কতকাল ধরে কতকিছু যে পাকতে পাকতে পচে গিয়ে এখন পুঁজ; সেই খবর অবুঝ ঢাকাইয়া-মিডিয়ায় আসেনি। আসেনি বলে আমাদের ঢাকাইয়া-নেতা-পিতা বুদ্ধিজীবী-শুদ্ধিজীবীরাও বুঝেনি। আর বুঝেনি বলেই এখন পুরো জাতিই ‘ঢাকা’ নামের ‘আন্ধাইর এক মাইনকাচিপায়।’
২০০৮ সালে মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস ম্যাগাজিনের এক জরিপে ঢাকাকে পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা শহরের মধ্যে দ্বিতীয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকা দেশের মোট আয়তনের ১ শতাংশ হলেও বাস করছে জনসংখ্যার ১২ শতাংশ মানুষ। ঢাকার বহুমাত্রিক সমস্যার গভীরতা অনুধাবন করতে এই একটি তথ্যই যথেষ্ট। সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা জরিপে ঢাকা শহর বিশ্বের সবচেয়ে অবাসযোগ্য বড় শহরের মধ্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগে একই জরিপে দ্বিতীয় বলে বিবেচনা করা হয়েছিল। প্রায় দেড় কোটি মানুষের শহর ঢাকায় নাগরিক সুযোগ-সুবিধার কী হাল তা এখানকার নাগরিকেরা হাড়ে হাড়ে টের পান। শুধুমাত্র যানজটের দুর্ভোগের কথা বললেই ‘মহাভারত’ হয়ে যাবে। আর এই যানজট শুধু বিভিন্ন সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুই নয়, এটি একইসঙ্গে সামাজিক ও অর্থনেতিক নানা সমস্যাও তৈরি করছে। নগরবাসী মাত্রই জানেন, তীব্র যানজটের ফলে ঢাকার বাসযোগ্যতা এবং পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগের সম্ভাবনা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তো বটেই, এমনকি অর্থনীতিবিদরাও প্রায়ই ভুলে যান যে, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্তে আসার আগে একটি শহরের বাসযোগ্যতাকে প্রথমেই মূল্যায়ন করেন। এখনও ঢাকার বাসযোগ্যতার সবচেয়ে বড় বাধা এই শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা। মূলত নারকীয় যানজটের কারণে এই শহর পৃথিবীর বিভিন্ন নগর সমীক্ষায় বসবাসের জন্য সবচেয়ে খারাপ শহরের খেতাব পাচ্ছে প্রায়শই।
সারা পৃথিবীতে আজ সবুজ, কার্বনমুক্ত নগরায়ণের যে আন্দোলন শুরু হয়েছে তার মূলভিত্তি ধরা হচ্ছে নগরের গণপরিবহন নির্ভরতাকে। কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটা, দক্ষিণ ব্রাজিলের শহর কুরিচিবা, আমেরিকার অঙ্গরাজ্য অরেগনের পোর্টল্যান্ড, ইউরোপের আমস্টার্ডাম আর বার্সেলোনা, এবং অস্ট্রেলিয়ায় মেলবর্ন শহরকে পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে গণপরিবহন নির্ভর সফল শহর হিসেবে। এই শহরগুলো গণপরিবহন ব্যবস্থার সঙ্গে ভূমিব্যবহারের সমন্বয় ঘটিয়ে মূল শহরে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে ফেলেছে। সেই সঙ্গে শহরগুলোকে করা হচ্ছে পথচারিকেন্দ্রিক এবং বাইসাইকেল নির্ভর। শহরের বাসযোগ্যতা, নগরস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের সামগ্রিক আকর্ষণীয়তা বাড়ছে। বেশি মানুষ গণপরিবহন ব্যবহার করা মানে হচ্ছে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কমা। যার ফলে রাস্তায় স্থান সংকুলান হচ্ছে বেশি। গতি বাড়ছে। বাতাসে কার্বন কমছে। সবচেয়ে বড় উপকার হচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সামাজিক সংযোগস্থল সম্প্রসারণের মাধ্যমে। গবেষণায় দেখা গেছে, বেশি মানুষ গণপরিবহন ব্যবহার করলে অপরাধপ্রবণতা কমে যায় এবং গণসম্পৃক্ততার পরিবেশ তৈরি হয়। গাড়িকেন্দ্রিক সড়কের ধারণা পরিবর্তন করে সড়ককে ভাবতে হবে চলাচল, বিনোদন, জনচত্বর এবং নগরস্বাস্থ্যের সম্মিলিত পরিসর হিসেবে।
একটি আধুনিক শহর গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর পাশাপাশি সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। অথচ ২০১০ সালে ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) করা হলেও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেই। স্বার্থান্বেষী মহল এটিকে হিমাগারে পাঠানোর সব আয়োজন সম্পন্ন করে রেখেছে। কিন্তু বসবাসযোগ্য সুন্দর ও সুবিন্যস্ত ঢাকার জন্য ড্যাপ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। পাশাপাশি, রাজনৈতিক সরকারকে দলীয় স্বার্থের ওপরে উঠে কিছু নীতিমালাকে ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তার সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মধ্যে অবশ্যই প্রশাসনিক কিছু দফতরকে অন্য শহরে নিয়ে যেতে হবে। এর ফলে বেসরকারি খাতেরও বিকেন্দ্রীকরণ হবে। অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ করতে বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্পকে ঢাকার নগর সীমানার বাইরে নিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, ঢাকায় অন্তত ২০ লাখ তৈরি পোশাককর্মীর বসবাস রয়েছে। সারা দেশের মোট ৮২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬০টিই ঢাকায়। সরকারি/বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অন্যান্য শহরে স্থানান্তরিত করার নীতিমালা তৈরি করতে হবে জরুরিভিত্তিতে। এছাড়া বিডিআর সদর দফতর এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টকে ঢাকার বাইরে নেওয়ার চিন্তাভাবনা শুরু হোক এখনই।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক / সম্পাদনা : জব্বার হোসেন