২১ আগস্ট ঘটনায় খালেদা-নিজামীর প্রত্যক্ষ মদত
ড. মিল্টন বিশ্বাস
দেশের মধ্যে জঙ্গি গোষ্ঠীর তৎপরতা এখনও অব্যাহত রয়েছে। ১ জুলাই (২০১৬) গুলশানের হলি আর্টিজান এবং ৭ জুলাই শোলাকিয়া ঈদ জামায়াতে হামলা ও হত্যাকা-ের পর ঢাকা শহরের কল্যাণপুরের ঘটনা সকলকে উদ্বিগ্ন করেছে। এরপর কয়েক’শ তরুণের নিখোঁজ হওয়া, জঙ্গি তরুণীদের গ্রেফতার করা, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের অপতৎপরতা সবই জেনেছে দেশবাসী। তবে এসব অপচেষ্টা বা তাদের সমর্থকদের তৎপরতার কথা আগে থেকে মানুষ জেনেছে। ২০১৩ সালের ১৩ আগস্ট জঙ্গি সংগঠন ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে’র নেতা মুফতি জসীমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরই মধ্যে সে ৫ হাজারের মতো অনুসারী তৈরি করেছে। হত্যাকারীরা তার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে হত্যাকা-ে অংশগ্রহণ করে ব্লগার রাজীবকে খুন করেছে। এখনও তাদের অনুসারীদের হিটলিস্টে মন্ত্রী, এমপি, সাংবাদিকসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা রয়েছেন। ২০১২ সালের ১৬ আগস্ট পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদের বাংলাদেশ শাখার সংগঠক গ্রেফতার হয়েছে ঢাকা শহরে। একই বছর ১৩ আগস্ট রাজধানীর পান্থপথের একটি রেস্তোরাঁ থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরির ৩৫ সদস্য গ্রেফতার হয়। অর্থাৎ গোপনে সংগঠিত হয়েছে হিযবুত তাহরির। ব্যাপক ধরপাকড়ের মধ্যেও থেমে নেই উগ্রপন্থিদের কার্যক্রম বরং গোপনে নতুন সদস্য সংগ্রহ ও উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি চালাচ্ছে তারা। ২০০৯ সালের অক্টোবরে নিষিদ্ধ হবার পরে পুলিশ এ পর্যন্ত ২৬০ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে। র্যাবও সমসংখ্যককে গ্রেফতার করেছে বলে সংবাদসূত্রে জানা গেছে। জামায়াত-শিবিরের কোচিং ব্যবসা থেকে শুরু করে অন্যান্য কর্মকা-ের সঙ্গে হিযবুতের আশ্চর্যরকম মিল রয়েছে। এ উভয় সংগঠনের রয়েছে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক। আল-কায়দা, লস্কর-ই-তৈয়বা, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ফ্রন্টসহ পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সম্পর্ক বহুদিনের। পৃথিবীব্যাপি সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িত সংগঠনগুলো এদেশকে একটি নিরাপদ চারণভূমি মনে করে। কারণ জামায়াত-শিবিরসহ অনেক জঙ্গিসংগঠন তাদের পক্ষে রয়েছে।
অধ্যাপক আবুল বারকাতের লেখা ‘বাংলাদেশে মৌলবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ প্রবন্ধ এবং জঙ্গিবাদের উত্থান সম্পর্কিত আরও কয়েকটি গ্রন্থ পাঠ করে দেশের মধ্যে ২০০৪ সালের ভয়াবহ গ্রেনেড ও ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলার নেপথ্যের চক্রান্ত ও সন্ত্রাসী রাজনীতির পূর্বাপর ইতিহাস আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকা-ের মধ্যে দিয়ে যে পাকিস্তানবাদী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির তৎপরতা শুরু হয়েছিল, তারই অনিবার্য ফল হচ্ছে জামায়াত-শিবিরের উত্থান। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় মৌলবাদী রাজনৈতিক সংগঠনের অপরাজনীতি শেকড় গেড়ে বসে। উল্লেখ্য, ক্ষমতা গ্রহণের পর সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া ১৯৭৬ সালে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি উন্মুক্ত করতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন (বিশেষ অধ্যাদেশ ৪ মে ১৯৭৬ এবং বাংলাদেশ সংবিধান, ৫ম সংশোধনী, ২২ এপ্রিল ১৯৭৭)। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্ব জামায়াতের রাজনীতি শুরু হয় এবং ইসলামী ছাত্র সংঘের কতিপয় নেতা ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭ সালে ঢাকায় সমবেত হয়ে পরিবর্তীত নাম ‘ইসলামী ছাত্রশিবির’ ধারণ করে নতুনভাবে কর্মকা- শুরু করে। এদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের মতো বাংলাদেশকে পরিচালনা করা। এ লক্ষ্যে শিবির দেশের ছাত্র ও যুব সমাজের মধ্যে গভীরভাবে প্রবেশের পরিকল্পনা করে। ১৯৮০-এর দশকে আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধে আমেরিকা ও পাকিস্তান আফগানিস্তানকে সহায়তা করে। আফগানিস্তানের পক্ষে শিবিরের সদস্যসহ বেশকিছু বাংলাদেশি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এরা পাকিস্তানে আইএসআই-এর অধীনে এবং আফগানিস্তানে তালেবানদের অধীনে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিল। পরবর্তীতে এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক বাংলাদেশি প্যালেস্টাইন ও চেচনিয়া যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছে। এরা প্রায় সকলেই বাংলাদেশে ফিরে আসে। এসব যুদ্ধ ফেরত সদস্যরাই পরবর্তীতে বাংলাদেশে আইএসআই, তালেবান ও আল-কায়দার স্থানীয় সদস্য হিসেবে এদেশে আইএসআই/এলইটির (লস্কর-ই-তৈয়বা) এজেন্ট হিসেবে গণ্য হয়। এভাবে আশির দশকের পর জামায়াতসহ মৌলবাদী সংগঠন ও তালেবানপন্থি গোষ্ঠী সংগঠিত হয়ে রাজনীতির আড়ালে ও ইসলামের নামে জঙ্গি সন্ত্রাসী কর্মকা-সহ বাংলাদেশকে মৌলবাদী ও তালেবান রাষ্ট্র বানানোর একই অভীষ্ট লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। ১৯৯১-এ জামায়াতের সমর্থনসহ বিএনপি ক্ষমতা গ্রহণ করার পর ১৯৯২ সালে জামায়াতের সহযোগিতায় ইসলামী জঙ্গি সংগঠন ‘হরকাতুল জিহাদ’ আত্মপ্রকাশ করে প্রকাশ্যে জিহাদের ঘোষণা দেয়। পরবর্তীতে কথিত জিহাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামি শাসন চালুর অভিন্ন আদর্শে জামায়াত ও ইসলামি জঙ্গি সংগঠনসমূহ একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ শুরু করে।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন