ব্যক্তি সচেতনতাই পরিবেশ সংরক্ষণের অন্যতম পথ
ড. তরুণ কান্তি শিকদার
যা অনেক সাশ্রয়ী ও পরিবেশ সম্মত। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো পরিবেশবিদকে এ নিয়ে আলোচনা করতে দেখিনি।
এ বিষয়ে একটি বাস্তব উদাহরণ উপস্থাপন করতে চাই। গত ঈদের ছুটির পর প্রথম দিন অফিস প্রধান হিসেবে প্রথাগতভাবে সকল কর্মচারীর সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে রুমে রুমে যাই। তখন রুমের মধ্যে অত্যন্ত মূল্যবান সেগুন ও লোহা কাঠের বেশকিছু আলমিরা আমার দৃষ্টিগোচর হয়। যার অধিকাংশই শতবর্ষ পূর্বের মহকুমা আমলের ব্যবহার্য বলে ধারণা। পাঠকের অবগতির জন্য জানিয়ে রাখতে চাই, তখন আমার কর্মস্থল নেত্রকোনা জেলা। বিভিন্ন সময়ে কৃষক বিদ্রোহ, গারো আন্দোলন দমনে ইংরেজ সরকার ৩রা জানুয়ারি, ১৮৮২ খ্রি. নেত্রকোনাকে মহাকুমা ঘোষণা করেন। যা পরে ১৭ জানুয়ারি ১৯৮৪ খ্রি. জেলায় উন্নীত হয়। কোনো এক সময়ে তৈরি এই অত্যন্ত মূল্যবান কাঠের আলমারিগুলো অযতœ আর অবহেলায় কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু কাঠের মূল্যমানে বর্তমানের যেকোনো ফার্নিচার থেকে দামী। কোনোটির পায়া নেই, কোনোটির হয়তো একটা দরজা ভাঙা, কোনোটি সিটকিনি লাগে না ইত্যাদি। এছাড়া একটু গায়ে রং এর প্রলেপের অভাবে এই সুদৃশ্য ও মূল্যবান আলমিরা রুমগুলোকে হতশ্রী করে দিয়েছে। আমি তাৎক্ষণিকভাবে এডিসিকে নির্দেশ দিলাম সবগুলো আলমিরা, চেয়ার, টেবিল একত্রিত করে সংস্কার সাধনের জন্য। বিভিন্ন রুম থেকে এবং বাথরুমের মধ্য থেকে এমন প্রায় শতাধিক আসবাবপত্র বের করা হলো। যার মধ্যে আছে আলমিরা, চেয়ার, টেবিল, রেক, কোশন কাঠের চেয়ার, ইজিচেয়ার ঈত্যাদি।
সব মিলিয়ে এই আসবাবপত্র নতুন করে তৈরি করতে হলে বিশেষজ্ঞ কাঠমিস্ত্রির হিসাব অনুযায়ী ২৪৫ সিএফটি কাঠ লাগবে। যার আনুমানিক বর্তমান বাজার মূল্য ৯,৮০,০০০ টাকা। এ কাজে কাঠমিস্ত্রির মজুরি বাবদ খরচ হতো ১,১০,০০০ টাকা এবং বার্নিশ ক্রয় এবং বার্নিশ মিস্ত্রির মজুরি বাবত খরচ হতো প্রায় ৩০,০০০ টাকা। সে সঙ্গে কোশন চেয়ার ১২টি তৈরিতে খরচ হতো ৬০,০০০ টাকা। সব মিলিয়ে উপরোক্ত সকল আসবাবপত্র নতুন করে তৈরিতে মোট খরচ হতো প্রায় ১১,৮০,০০০ টাকা। কিন্তু মাত্র ৩০ কর্মদিবস ব্যয় করে ৪ জন কাঠ মিস্ত্রিকে মাত্র ৪৮,০০০ টাকা মুজুরি প্রদান করে ও ১৫ সিএফটি কাঠ লাগিয়ে সম্পূর্ণ আসবাবপত্রগুলোর কব্জা, তারকাটা, বার্নিশ ক্রয়সহ যাবতীয় সংস্কার সাধনে খরচ হলো মাত্র ১,০৬,৯০০ টাকা সঙ্গে ভ্যাট। এতে সরকারের আর্থিক সাশ্রয় হয়েছে আনুমানিক ১০,৭৪,০০০ টাকা। আমার হিসেবটি আর্থিক নয়। মূল বিষয়টি পরিবেশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত। আসবাবপত্রগুলো যত্রতত্র রেখে অফিসের পরিবেশ নষ্ট করেছিল। এই ছোট্ট উদ্যোগটি অফিসের সুন্দর পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। যার পরিবেশগত মূল্য আর্থিক মূল্য থেকে অনেক বেশি বলে আমার ধারণা।
কাজটি দেখে অনেকেই ভালো মন্তব্য করেছেন। কর্মচারীরা বিশেষ করে খুবই খুশি কারণ শতবর্ষের এই ফার্নিচারগুলোর গায়ে কখনও রং দেখেনি। তারা সাহসে ভর করে কোনো জেলা প্রশাসককে বলতেও পারেনি। আজ তারা রুমে বসে একটা নতুন সুদৃশ্য আলমিরা ব্যবহার করছেন। যা থেকে নতুন রং এর গন্ধ বের হয়ে তাকে আরও উদ্দীপ্ত করছে। একটা পরিচ্ছন্ন পরিবেশে অফিস করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ শুধু নিজের রুমটিকে পরিচ্ছন্ন রাখতে চেষ্টা করি। কিন্তু সকলকে নিয়ে যে পরিবেশ তার দিকে কজন লক্ষ্য করছি। তবে তীর্যক দৃষ্টি দিতেও কেহই কার্পণ্য করেনি। অনেকেই বলছেন ডিসি সাহেব শুধু ভাঙাচোরা জিনিস মেরামত করতেই ব্যস্ত। নতুন জিনিস না কিনলে দেশের অগ্রগতি হবে কেমন করে। এমন নিন্দুক মন্তব্যকারী ও তোষামোদকারী সবসময়ই চারপাশে থাকবে। তাতে কিছু এসে যায় না।
রং ব্যবহার : ছোট ছোট ধারণা জীবনযাত্রার মান পাল্টে দিতে পারে। মনে করুন একজন খুব পরিবেশ সচেতন ব্যক্তি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন পরিবেশবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেমন চটকদার বক্তৃতা করে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেন তেমনি রুচিশীল রং-বেরং এর পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করেন। তিনি দেশের ডাইং শিল্পের বিরুদ্ধে কারণ এ শিল্পদ্বারা নদী দূষণের হার সবচেয়ে বেশি। একটু লক্ষ্য করুণ, উক্ত ব্যক্তি রং-বেরং এর বর্ণিল ও আকর্ষণীয় পরিচ্ছদ পরে ডাইয়িং শিল্পের বিপক্ষে কথা বলছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, কাপড় যত রং করা বেশি হবে পরিবেশকে তার দূষণের দায়ভার তত বেশি মাথায় নিতে হবে। প্রতিটি কাপড় একাধিকবার রং করতে অসংখ্য দূষণকারী বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য পানি ও মাটিতে মিশ্রিত হচ্ছে। দূষণ সৃষ্টি করছে সর্বত্র। তাহলে এই দূষণ রোধ করতে হলে কী আমরা রঙিন কাপড় ব্যবহার ছেড়ে দিয়ে সকলে বিশিষ্ট সাদা মনের মানুষ আবুল মকসুদ এর মতো সাদা বস্ত্র পরিধান করব। তা হয়তো সবক্ষেত্রে সম্ভব নয়। কিন্তু বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সাদা রং ব্যবহার পাল্টে দিতে পারে আপনার পরিবেশ সচেতনতা বোধ। কী দরকার পরিবেশ দিবসের আয়োজনে পরিবেশ সম্মত সবুজ, নীল, বা আকাশী রঙের গেঞ্জি পরিধান করে পরিবেশ দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়া। পরিবেশ দিবসের রং হোক সাদা। তাহলে প্রকৃতি অধিক উজ্জ্বল থাকবে। এভাবে আমরা পরিবারিক জীবনে যদি প্রতিটি পদক্ষেপ হিসাব করি তাহলে পরিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখতে বাধ্য।
মূল কথা হলো অবস্থা বিবেচনা করে আমাদের উন্নয়ন ভবনা ভাবতে হবে। প্রতি বছরই ২/১ লাখ টাকা আমাদের আসবাবপত্র মেরামতে খাতে বরাদ্দ আসে। আমরা টুকটাক কাজ করে তা শেষ করে ফেলি। খুব একটা লক্ষ্য রাখতে পারি না। কিন্তু একটু খেয়াল রাখলেই জনগণের দেওয়া অর্থের যথেষ্ট সদব্যবহার করা সম্ভব। আর এ জন্য পরিবেশ সংরক্ষণের ৪-জ এর ব্যবহার আর একবার মনে করিয়ে দিতে চাই। কারণ পরিবেশ সংরক্ষণে ৪-জ একটি উল্লেখযোগ্য টুলস। ৪-জ এর ব্যবহার নিশ্চিত হলে পরিবেশ যেমন সুরক্ষা পাবে তেমনি এর মাধ্যমে অর্থের সাশ্রয়ও হবে।
তাই সার্বিক বিবেচনায় মানুষের জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং প্রতিটি মানুষের মনে পরিবেশ সংরক্ষণের বোধ তথা প্রয়োজনীয়তা জাগ্রত করতে হবে, না পারলে অধরা রয়ে যাবে সকল আয়োজন। ছোট ছোট উদ্যোগ হতে পারে বৃহৎ কাজের সূচনা। শুধু ঢাকা শহরের ১.৫ কোটি মানুষ যদি প্রতিদিন তার ব্যবহার্য পানি থেকে ৫ লিটার পানির অপচয় কম করে তাহলে ৭.৫ কোটি লিটার পানি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়। যা ৫০ হাজার মানুষের সুপেয় পানির সংস্থান করতে পারে।
লেখক : কবি ও যুগ্ম সচিব / সম্পাদনা : জব্বার হোসেন