বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িক ভাবনা
হাবীব ইমন
১৯৯৬ সালের আগের কথা। এত গণমাধ্যম তখন ছিল না। ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন আর কয়েকটি সংবাদপত্র। তাও সেখানে আস্থার জায়গাটি ছিল খুব আশাহত। একমাত্র সম্প্রচারমাধ্যম হিসেবে বিটিভি ছিল সঙ্কুচিত। ১৫ আগস্ট, ৭ মার্চ এলে বিভিন্ন জায়গায় মাইক উঁচু করে বাজানো হতো বঙ্গবন্ধুর অবিসংবাদিত ভাষণ। আর কিছু দেশাত্ববোধক গান। আমরা শুনতাম বেশ আগ্রহ নিয়ে। কী সুললিত-তেজদীপ্ত সেই ভাষণখানা। তার মতো সাহসী ও দৃঢ়চিত্তের জননেতা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তিনি ৭ মার্চের দুনিয়া কাঁপানো ভাষণে বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাংলাদেশের রাজনীতিতে উজ্জ্বল পুরুষ কমরেড মণি সিংহের মতে, ‘৭ মার্চের ঘোষণা ছিলÑ প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতারই ঘোষণা। এই ঘোষণা উপস্থিত জনতা ও দেশবাসীকে উদ্দীপ্ত অনুপ্রাণিত করে সীমাহীনভাবে।’ ওই ভাষণটি শুনতে পেতাম অডিওতে। ভিডিও দেখার সুযোগ আমাদের তখনও হয়নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলো ছিয়ানব্বই সালের ২৩ জুন। ওইদিনই বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি। দীর্ঘ একুশ বছর এ ভাষণটিকে বাক্সবন্দি করে রাখা হয়েছে। মনে হলো এই তো ‘বঙ্গবন্ধু’ আছে। কী এক তাৎপর্যপূর্ণ আবেগপ্রবণ মুহূর্ত! কী এক জ্বাজল্যমান স্মৃতি। অনেক মানুষকে সেই সময় চোখের পানি ফেলতে দেখেছি।
আমি বা আমার বয়সী যারা, পঁচাত্তর পরবর্তী প্রজন্ম। এ প্রজন্মটি ছিয়ানব্বই সাল আসার আগে প্রচারিত অনেক বিকৃতি ও অসত্যকে মস্তিষ্কে ধারণ করেছে। বঙ্গবন্ধু বা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অনেক অকাট্য সত্য জানার সুযোগ আমাদের ছিল না। ইতিহাস তো ইতিহাসই। একে অস্বীকার করা যায়! ইতিহাসকে নিজের মতোন করে বানানো যায় না। ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু নামটি থাকবে। অনেক চেষ্টা হয়েছিল তার নামটি নিশ্চিহ্ন করতে। আজ ৪১ বছর পরও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা, ঐতিহাসিক আবেদন অনেক বেশি বলিষ্ঠ। বঙ্গবন্ধুর অনেক ভাষণ-বক্তব্যে তার সমাজতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িক ভাবনাগুলো ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
সারাবিশ্বে সেই সময় সমাজতন্ত্রের প্রভাব পূর্ণমাত্রায় বহাল ছিল। সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন বলিষ্ঠ সমর্থন দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে বড় মাপের ভূমিকা রাখে। তাছাড়া ষাটের দশকের পর আওয়ামী লীগের ইশতেহারের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি সংযোজন করা হয়। আবার সদ্য স্বাধীন দেশের রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র শুরু হলো। শুরু হলো দেশের বাইরেও। দেশে যখন খাদ্যের অভাব, তখন চাল বোঝাই জাহাজ হঠাৎ করে বাংলাদেশে না এসে অন্যদিকে চলে গেল। ফলে মানুষের ক্ষুধা-দেশে দুর্ভিক্ষ বেড়ে গেল। সেই সময় রাষ্ট্রের বিভিন্ন জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করে অকার্যকর করে তোলা, পাটের গুদামে আগুন দেওয়া, চাউল-চিনি-ময়দা-ডাল কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দিয়ে খাদ্যাভাব তৈরি করা, ধনী-গরীবের বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি করে নব্যধনীদের উত্থান হয়।
মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু লুটেরা পুঁজি ও নব্যধনীদের অভ্যুত্থানের আশঙ্কা করেনি তা নয়। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন আওয়ামী লীগ যেহেতু একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনৈতিক সংগঠন, সেহেতু এই সংগঠনেরও শ্রেণিচরিত্র বদল ঠেকানো যাবে না। উঠতি মধ্যবিত্তের শ্রেণিচরিত্র ত্যাগ করে আওয়ামী লীগ দ্রুত উঠতি ও লুটেরা পুঁজিপতিদের শ্রেণিচরিত্র লাভ করবে। দেশ আবার সামন্তবাদী, সাম্প্রদায়িক ও বিশাল শ্রেণিবৈষম্য ও বঞ্চনার দেশে পরিণত হবে। কেবল সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে লিপিবদ্ধ করে শোষক পুঁজির বিকাশ ও থাবা থেকে দেশকে তিনি বাঁচাতে পারবেন না। ফলে তিনি জীবন বাজি রেখে আওয়ামী লীগের শ্রেণিচরিত্রকে পুঁজিবাদী প্রবণতা থেকে রক্ষা করে বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কৃষক-শ্রমিকের শ্রেণিচরিত্র দ্বারা তাকে পুনঃগঠিত করতে চেয়েছিলেন। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কাঠামো সংকুচিত করে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বাকশাল রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন।
লেখক : কলামিস্ট / সম্পাদনা : জব্বার হোসেন