সরকারকেই সুন্দরবন রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে
ওয়াসিম ফারুক
সুদূর অতীতকাল থেকেই বাংলাদেশ অরণ্য সমৃদ্ধ একটি দেশ। কালের বিবর্তনে ধ্বংস হতে চলছে এদেশের বনজ সম্পদ ও বনভূমি। সুন্দরবন, বাংলাদেশ তথা বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি অংশ। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এই সুন্দরবনকে ধ্বংস করা জন্য দেশি-বিদেশি চক্রান্ত সবসময়ই সক্রিয়। বিভিন্নভাবে সুন্দরবন ধ্বংসে পায়তারা করছে। সুন্দরবনকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য সবসময় চেষ্টা করে আসছে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি, দেশের বিশিষ্ট নাগরিকেরা। সুন্দরবনের কাছে রামপালে কয়লাভিত্তিক একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়ে চরম বিতর্কের মধ্যে পড়েছে সরকার, যা রাজনৈতিক অঙ্গন পেরিয়ে নাগরিক সমাজে ঢুকে পড়েছে। ২০১১-এর জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক হয়, যাতে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সঞ্চালনের বিষয়টি ছিল। এরপর রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ২০১২ সালের ২৯ জানুয়ারি সুন্দরবনের নিকটবর্তী রামপালে দুটি ৬৬০ ইউনিট মিলে মোট ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশনের (এনটিপিসি) সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। কিন্তু ওই চুক্তিটি এমন সময় স্বাক্ষরিত হলো যখন দেশের পরিবেশবাদী সংগঠনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন এর প্রবল বিরোধিতা করছে এবং হাইকোর্টও সেখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন না করতে কেন নির্দেশনা দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে। এমতাবস্থায় তড়িগড়ি করে পরিবেশ অধিদপ্তরের এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) রিপোর্টে এই প্রকল্পকে পরিবেশবান্ধব বলে সার্টিফিকেট দেয় এবং সেই প্রতিবেদন অনলাইনে আপলোড করে জনগণের মতামত চাওয়া হয়। অথচ নিয়ম হচ্ছে প্রকল্প শুরুর আগেই ইআইএ প্রতিবেদন তৈরির পর সেটার ভিত্তিতে প্রকল্প অনুমোদন বা বাতিল করা। আর সেই প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে ২০ এপ্রিল ২০১৩ ঢাকায় ভারতের সঙ্গে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। স্বাক্ষরিত তিনটি চুক্তির মধ্যে ছিলÑ যৌথ উদ্যোগ চুক্তি, বাস্তবায়ন চুক্তি ও বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি। অথচ এই ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশন (এনটিপিসি) ভারতের ছত্রিশগড়ে একটি ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছিল কিন্তু ভারতের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের গ্রিন প্যানেলের ইআইএ রিপোর্ট প্রকল্পটিকে পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি বলে প্রতিবেদন দাখিল করলে ভারত সরকার উক্ত প্রকল্পটি বাতিল করে। তাই স্বাভাবিক প্রশ্ন, যে প্রকল্প ভারত সরকারে পরিবেশ ছাড়পত্র পেতে ব্যর্থ সেটি কিভাবে বাংলাদেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পেল? একটু জেনে নিই, আবাসযোগ্য পৃথিবীর জন্য বনভূমির প্রয়োজনীয়তা। একটি দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য মোট ভূমির প্রায় ২৫% বনভূমি থাকা প্রয়োজন, আমাদের দেশের মোট ভূমির কম বেশি মাত্র ১৭% ভাগ বনভূমি। আর এই বনভূমির বিরাট অংশই দখল করে আছে সুন্দরবন। দেশের উপকূলীয় এলাকাসমূহের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে গড়ে উঠায় প্রতিনিয়ত নানা প্রাকৃতিক দূর্যোগের হাত থেকে সুন্দরবন আমাদের রক্ষা করে আসছে।
অথচ সুন্দরবনের মাত্র কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেই হতে যাচ্ছে বিশাল রামপাল কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প। রাক্ষুসে এই প্রকল্পের প্রথম শিকার হয়েছেন প্রকল্পে ১৮৩৪ একর জমির সীমানার স্থানীয় কয়েক হাজার পরিবার ও উক্ত জমিতে উৎপাদিত ফসল, শাক-সবজি, মাছ ও গৃহপালিত পশুপাখি ইত্যাদির। পরিবেশগত দিক দিয়ে কয়লাভিত্তিক যেকোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প অন্য যেকোনো প্রকল্পের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। বিশেষভাবে ভষ্মিভূত কয়লার ছাই ও উৎপন্ন গ্যাসের ফলে বাতাস এবং পানি দূষণের ক্ষতি হয়। এ ধরনের প্রকল্প এলাকার আশপাশের অঞ্চলে এসিডবৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে, যা বৃক্ষ এবং বনাঞ্চলের ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে প্রতি ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রায় ২.২ বিলিয়ন গ্যালন পানির প্রয়োজন হয়। আর তাই রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের পানির চাহিদা পূরণের জন্য পশুর নদই একমাত্র ভরসা। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মালামাল ও যন্ত্রপাতি সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে নদীপথে পরিবহন করা হবে। ফলে বাড়তি নৌযান চলাচল, তেল নিঃসরণ, শব্দদূষণ, আলো, বর্জ্য নিঃসরণ ইত্যাদি সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম বিশেষ করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, ডলফিন, ম্যানগ্রোভ বন ইত্যাদির উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। অথচ এই পশুর নদের পানিই অত্র এলাকার নোনা ও মিঠা পানির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ এর ভারসাম্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখছে। ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে, বিদ্যুৎকেন্দ্র অপারেশনে থাকা অবস্থায় ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই-অক্সাইড ও ৮৫ টন বিষাক্ত নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড নির্গত হবে। এছাড়াও পশুর নদ থেকে প্রতিঘণ্টায় ৯ হাজার ১৫০ ঘনমিটার করে পানি প্রত্যাহার করা হবে। যদিও সঠিকভাবে পরিশোধনের কথা বলা হয়েছে, তারপরও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্গমণ করা পানি কখনোই দূষণমুক্ত করা সম্ভব নয়। তাই বিভিন্নভাবে পরিবেশ দূষণের কথা মাথায় রেখে উন্নত বিশ্বের দেশগুলো এ ধরনের প্রকল্প এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আর্থিক দিক থেকে দেখলে, রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি হবে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দুই দেশের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি নামে একটি কোম্পানিও গঠন করা হয়েছে। এই প্রকল্পের অর্থায়ন করবে ১৫% পিডিবি, ১৫% ভারতীয় পক্ষ এবং ৭০% ঋণ নেওয়া হবে। যে নিট লাভ হবে সেটা ভাগ করা হবে ৫০% হারে। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, কার স্বার্থে এবং কোন স্বার্থে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প? বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিদ্যুতের চাহিদা, সেই চাহিদা পূরণে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এটাই বাস্তবতা। কিন্তু দেশ ও জাতির ঐতিহ্য, সম্পদ, স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হোক এটা মোটেও কাম্য নয়। গেল বছর, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সর্Ÿোচ্চ পুরস্কার ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ’ অর্জন করেছেন, যা জাতির জন্য গর্বের বিষয়। তাই এই গর্বকে ধরে রাখতে হলে সরকারকে রামপালের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে সরে এসে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশকে সুরক্ষার দায়িত্বপালন করতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট / সম্পাদনা : জব্বার হোসেন