সুন্দর আর অসাম্প্রদায়িকতার বিজয়গাঁথা
২৫ আগস্ট, শুভ জন্মাষ্টমী। হিন্দু শাস্ত্রমতে, ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ-এর মানবরূপে মর্তে আবির্ভাব ঘটে। আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে দ্বাপর যুগে এ দিনে এক বৈরি সমাজে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের উদ্দেশ্যে নিরাকার ব্রহ্ম বাসুদেব ও দেবকীর সন্তান হিসেবে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। দ্বাপর যুগে ওই সময়টাতে একটা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম ছিল। কতিপয় রাজা রাজধর্ম, কুলাচার, সদাচার ভুলে গিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা, অন্যায়-অবিচারে মত্ত হয়ে উঠেছিল।
একই রকম ত্রাসের শাসন চালিয়েছিল জরাসন্ধ, চেদিরাজ, শিশুপালসহ অনেক রাজা। রাজা জরাসন্ধ নাকি একাই ৮৬ জন যুব রাজাকে বলি দেওয়ার জন্য কারাগারে রেখেছিল। এছাড়া হস্তিনাপুরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল দুর্যোধন-দুঃশাসন। মহাভারতে কাহিনীতে বর্ণিত, দুঃশাসনকর্তৃক সভাসমক্ষে কুলবধূ দ্রৌপদীর অবমাননা এক লজ্জাকর অধ্যায়। জনসমক্ষে নারীর এমন অবমাননার প্রতিবাদ করার সাহস ছিল না তখন সৎ-ধার্মিক ব্যক্তিদের। এভাবেই তখন পাপের রাজ্যে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদতো। এহেন অধর্ম-অবিচার নির্মূল করে ধর্ম প্রতিষ্ঠার নিমিত্তেই শ্রীকৃষ্ণরূপে ভগবানের মর্তে আগমন। তাই শ্রীকৃষ্ণ মর্তে এসে একে একে কংস, শিশুপাল, জরাসন্ধ ও কৌরবদের দর্প চূর্ণ করে, তাদের পাপসৌধ ধ্বংস করে ধর্মরাজ্য স্থাপন করলেন।
শৈশব থেকেই মনুষ্যশিশু শ্রীকৃষ্ণ একের পর এক অতিমানবিক ঘটনা ঘটাতে থাকেন, যা লীলা হিসেবে আখ্যাত। লীলাবলে ও লীলাছলেই শ্রীকৃষ্ণ ধ্বংস করেন কংসসহ অত্যাচারী রাজাদের।
অনন্ত অসীম পরম প্রেমময় পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ। তার প্রেমময়-আনন্দময় রূপ, রাধিকার সঙ্গে লীলা বৈষ্ণব সাহিত্যের মূল উপজীব্য। বৈষ্ণব দর্শন বলে, রাধিকাসহ ব্রজগোপীগণের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পরমাত্মা আর জীবাত্মার মধ্যকার সম্পর্ক প্রতিভাত। প্রেমরূপের বিপরীতে গীতায় আমরা পাই কর্মযোগের উপদেশক শ্রীকৃষ্ণ। যার মুখে নিষ্কাম কর্ম ও ব্রহ্মজ্ঞানে জীবসেবার বাণী। মহাভারতের আখ্যানে শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধের সারথী, রাজনীতির মন্ত্রক। শ্রীকৃষ্ণ একাধারে দার্শনিক, রাজনীতিবিদ, যোদ্ধা, অনাথের নাথ ও অগতির গতি। নররূপী নারায়ণ ও মঙ্গলময় ঈশ্বর।
ইতিহাস লেখক ভুবন মোহন বসাক এবং যদুনাথ বসাকের দুটি বইয়ের তথ্যানুসারে জন্মাষ্টমী উৎসবে মিছিলের শুরু হয়েছিল ষোড়শ শতকে।
ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় যে ছেদ পড়েছিল, সুখের বিষয় রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে আবার সেই ঐতিহ্য ফিরে এসেছে। নিঃসন্দেহে এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হবে। জন্মাষ্টমীতে জাতীয় ছুটি পালনও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ব্যাপারে অনুকূল রাষ্ট্রীয় বার্তাবরণেরই পরিচয় দেয়। এটা সত্যি, সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রশ্নটি ওই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর ঐতিহ্যবাহী জন্মাষ্টমী উৎসব আড়ম্বরপূর্ণভাবে পালনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন এবং বর্তমানে তারই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর থেকেই পিতার ধারাবাহিকতায় ঐতিহ্যবাহী জন্মাষ্টমী উৎসব আড়ম্বরপূর্ণভাবে পালনে বিশেষ দৃষ্টি ও আনুকূল্য প্রদান করে যাচ্ছেন যা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে দীর্ঘ সংগ্রাম আর বহু ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত এই অসাম্প্রদায়িক স্বপ্ন সাধের সোনার বাংলাদেশে ত্রুটিপূর্ণ ও পক্ষপাতদুষ্ট সংবিধান, রাষ্ট্রধর্ম, অর্পিত সম্পত্তি, শত্রু সম্পত্তি আইনের মতো কালাকানুনসহ ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য এখনও বর্তমান। তাছাড়া হাজার হাজার বছর ধরে হিন্দু শাস্ত্রীয়মতে প্রচলিত হিন্দু বিবাহ আইনে অযাচিত হস্তক্ষেপ ও হিন্দু নারীদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারের নব্য আইন প্রনয়নসহ বিভিন্ন হিন্দু আইন সংস্কারের নামে ধর্মটিকে ধ্বংস করতে একটি বিশেষ স্বার্থান্বেষী মহল বর্তমানে সদা তৎপর। ঠুনকো অজুহাতে সারাদেশে মন্দির ও প্রতিমা ভাংচুর, মন্দির ও উপাসনালয়ের জমি দখল, সংখ্যালঘু নির্যাতন ও ধর্ষণ, পুরোহিত হত্যা ও জীবননাশের হুমকিÑ প্রায় প্রতিদিনের সংবাদ মাধ্যমগুলোর শিরোনাম। আবার অজপাড়া গাঁয়ের কোনো মন্দির বা প্রতিমা ভাংচুর এবং সংখ্যালঘু গরিব কিশোরী মেয়েটার নির্যাতনের ঘটনা হয়তো বা জানতে পারেন না কেউই, থেকে যায় অন্তরালে।
আমাদের একান্ত চাওয়া, আজকের এ শুভদিনে উৎসবের আনন্দ সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক; সবার অন্তরে শুভবোধ জাগ্রত করুক। জন্মাষ্টমী আমাদের দ্বারে উপস্থিত হয়েছে, সর্বজনীনভাবে তাকে মননে, চিন্তায় ধারণ করে কর্মে প্রতিফলিত করতে পারার মধ্যেই রয়েছে এ দিনটি উদ্যাপনের সার্থকতা।
লেখক : চিকিৎসক, সংগঠক ও কলামিস্ট
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন