কপিল ভট্টাচার্যের ‘ভারত বিরোধিতা’
পত্রিকায় নিশ্চয়ই দেখেছেন, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। তার বক্তব্যের সারমর্ম হলোÑ বিহারের বন্যা পরিস্থিতির খোঁজ নিতে মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ ফোন করেন নীতিশকে। তখনই ঠিক হয়, দিল্লি গিয়ে রাজ্যের হাল সবিস্তার জানাবেন নীতিশ। সোমবার ৭ রেসকোর্সে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে দেখা করেন নীতিশ। আলোচনার সময় মোদির হাতে একটি স্মারকলিপি দেন নীতিশ। তার অভিযোগ, বিহারে গঙ্গা অববাহিকায় বন্যার জন্য ফারাক্কা বাঁধ দায়ী। বক্সার থেকে ফারাক্কা পর্যন্ত গঙ্গার নাব্যতা অনেকটাই কমেছে। ফলে জল জমে তা দু’পার ছাপিয়ে যাচ্ছে এবং বন্যা কবলিত এলাকা বাড়ছে। তাই ফারাক্কা বাঁধের পুনর্মূল্যায়ন জরুরি। ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন নীতিশ। বিষয়টি মূল্যায়নের জন্য তিনি একটি বিশেষজ্ঞ দল পাঠানোর দাবি জানালে মোদি তা মেনে নিয়েছেন। (সূত্র: আনন্দবাজার, ২৪ অগাস্ট ২০১৬)
ওদিকে নীতিশের দাবি প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র বলেন, ‘আমি এক সময় ফারাক্কা বাঁধের সমালোচনা করেছি। কিন্তু ১৯৭৫ সাল থেকে বাঁধটি রয়েছে। এর ফলে ফারাক্কা থেকে মোহনা পর্যন্ত পরিবেশ বদলে গিয়েছে। এক ধরনের ইকোলজি তৈরি হয়েছে। কোনোভাবে বাঁধ ভেঙে দেওয়া হলে তার মারাত্মক প্রভাব পড়বে পরিবেশের উপর।’
কল্যাণ রুদ্রের কথা থেকে এটুকু স্পষ্ট, আজকের দিনে ফারাক্কা বাঁধ এক ধরনের নতুন প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করলেও এর পরিকল্পনাটাই ছিল ক্ষতিকর, গণবিরোধী। এর আগেকার বাস্তুসংস্থানের বিপুল ক্ষতি সে করেছে।
কিন্তু বাংলাদেশের কথা ভাবলে? ফারাক্কা বাঁধ গোটা দেশটির ক্ষতি আজও করে চলেছে, তার বিধ্বংসী প্রভাব আজও অনুভূত হচ্ছে। উত্তরবঙ্গে সে বাড়াচ্ছে মরুপ্রবণতা, দক্ষিণবঙ্গে সে টেনে আনছে লবণাক্ততা। আস্ত একটা রাষ্ট্র বাংলাদেশের ক্ষতি করে ফারাক্কা যে টিকে রয়েছে, সেই কথাটি আনন্দবাজারে আসেনি, যদিও বিহারের ক্ষয়ক্ষতির কথা এসেছে। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রপ্রধানরা দেশের ক্ষয়ক্ষতির কথা তুলে ধরার সাহস কিংবা যোগ্যতা কবে অর্জন করবেন?
এই কথাটি পঞ্চাশের দশক থেকে কলকাতা শহরে একজন মানুষ ক্রমাগত বলে এসেছেন, তিনি কপিল ভট্টাচার্য। এই বাঁধটির বিরোধিতা করার জন্য তখনকার দিনে দৈনিক ‘আনন্দবাজারে পাকিস্তানের চর’ হিসেবে আখ্যা পাওয়া কপিল ভট্টাচার্য দেখিয়েছিলেন, এমনকি ভারতের সাধারণ মানুষের স্বার্থেও না, বাঁধটি তৈরি হয়েছিল রাজনৈতিক কারণে, হয়েছিল বৃহৎ পুঁজির স্বার্থে। কপিল বলেছিলেন, পদ্মার মুখে এই বাঁধ পলি জমিয়ে উজানেও ভয়াবহ দুর্যোগের সৃষ্টি করবে। আজ বিহার, উত্তর প্রদেশের মানুষও সেই বিপদ টের পাচ্ছেন। যাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য এই বাঁধ, সেই বাংলার মানুষ তো ভুগছেনই। নদী নিয়ে দিল্লির চক্রান্তমূলক তৎপরতা জনগণের সামনে প্রকাশ করার জন্য আস্ত একটি বই বাংলায় লিখেছিলেন বলেই জন্ম নিয়েছিল বাংলা ভাষায় নদী বিষয়ক প্রথম গ্রন্থটি: বাংলাদেশের নদ-নদী ও পরিকল্পনা। কপিল ভট্টাচার্য আঞ্চলিক সহযোগিতার স্বপ্ন দেখেছিলেন, স্বপ্ন দেখেছিলেন পারস্পরিক সুবিধা-অসুবিধা আর অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে নদী ব্যবস্থাপনার। কপিলের ভারত রাষ্ট্রের বিরোধিতা ভারতের জনগণের স্বার্থ রক্ষার একমাত্র উপায়, বাংলাদেশের জনগণেরও।
এমনও মানুষ আছেন বাংলাদেশে, যারা ভারাক্কা বাঁধ ভেঙে দেওয়ার দাবি করায় মাওলানা ভাসানীকে ভারত বিরোধী সাম্প্রদায়িক ইত্যাদি বলতে সময় নেন না। কিন্তু এই মহৎ মানুষেরা রাষ্ট্র, শ্রেণি কিংবা দলের স্বার্থের উপরে উঠতে পেরেছিলেন, পেরেছিলেন এরও বাইরে প্রকৃতির স্বার্থ, গণমানুষের স্বার্থটাকে দেখতে।
ফারাক্কা দিয়ে আরও প্রবল বন্যা সম্ভবত আসবে, কেননা বিহারের বন্যা সামলাতে ফারাক্কার কপাটগুলো খুলে দেওয়ার হুকুম এসেছে। এভাবে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে যেভাবে পানির ওপর একচেটিয়া কর্তৃত্ব নিয়েছে ভারত, তার জন্য প্রধান দায় বাংলাদেশেরই শাসকদের। ভারত তার চিরশত্রু পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধু নদীর জল নিয়ে এমন আচরণ করার সাহস দেখাবে না।
ফারাক্কার প্রসঙ্গে প্রগতিশীলরা যদি নিশ্চুপ থাকে, এর ফায়দা পুরোটা লুটবে প্রতিক্রিয়াশীলরাই। ভারত রাষ্ট্রের এই নিপীড়নকে তারা সাম্প্রদায়িক রূপ দিবে, হিন্দু বিরোধী বিদ্বেষ সৃষ্টি করবে। কিন্তু ভারত রাষ্ট্রের যে নিপীড়নকে কপিল ভট্টাচার্য দেখিয়েছিলেন জনগণের মতামত, আঞ্চলিক পরিবেশ আর প্রকৃতিকে উপেক্ষা করে ভারতের বৃহৎ পুঁজির স্বার্থের জয় হিসেবে, কল্পনা করেছিলেন আঞ্চলিক মৈত্রীর, যার ভিত্তিতে নদীর ব্যবস্থাপনা হবে ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক, সেই আহ্বানকে কি করে আমরা উপেক্ষা করি?
ভাসানীও তো ফারাক্কা নিয়ে সেই স্বপ্নই দেখেছিলেন, যেখানে প্রকৃতির ভাগের ন্যায্য হিস্যা চাইতে গিয়ে বাংলাদেশের সরকারকে নতজানু হয়ে থাকতে হবে না।
লেখক : কেন্দ্রীয় সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন। সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন