
যাবজ্জীবন কারাদ- : আমৃত্যু নাকি ত্রিশ বছরের কারাদ-?
উপনিবেশিক বৃটিশদের শাসনামলে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে আমাদের মূল দ- আইন দ-বিধি প্রণীত হয়। দ-বিধির দীর্ঘ পথযাত্রায় সময় ও যুগের প্রয়োজনে এটিতে বিভিন্ন সময়ে সংযোজন, বিয়োজন ও প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে সংশোধনী আনা হলেও এটির মূল ধারাসমূহে বিভিন্ন অপরাধ যেভাবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে তা পূর্বাপর অক্ষুণœ রয়েছে। দ-বিধির বিধান অনুযায়ী অপরাধের সাজা বা দ- ৫ (পাঁচ) ধরনের যথাÑ মৃত্যুদ-, যাবজ্জীবন কারাদ-, সশ্রম অথবা বিনাশ্রম কারাদ-, সম্পত্তির বাজেয়াপ্তি ও অর্থদ-। আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনাল ব্যতীত অপর কোনো কর্তৃপক্ষ উপরোক্ত দ-সমূহের যে কোনোটি প্রদানের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত নয়, যদিও আদালত বা ট্রাইব্যুনালকর্তৃক সাজা প্রদানান্তে রাষ্ট্রপতি বা সরকারের যেকোনো দ- মার্জনা করার অধিকার রয়েছে।
দেশে অনেকের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে, যাবজ্জীবন কারাদ- অর্থ ৩০ (ত্রিশ) বছরের কারাদ- এবং আমৃত্যু কারাদ- নয়। এ বিষয়ে দ-বিধির বিধান স্পষ্ট। দ-বিধির ধারা নং ৫৭ দ-ের মেয়াদসমূহের ভগ্নাংশ বিষয়ক। এ বিষয়ে ধারাটিতে বলা হয়েছে, দ-ের মেয়াদসমূহের ভগ্নাংশসমূহ হিসাব করবার ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাবাসকে ৩০ (ত্রিশ) বছর মেয়াদি কারাবাসের তুল্য বলে ধরা হবে।
দ-বিধির যে দুটি ধারায় দ-ের মেয়াদের ভগ্নাংশ বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে এ দুটি ধারা হলোÑ ধারা নং ১১৬ ও ৫১১। ধারা নং ১১৬[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: }থএড়ইধপশ[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: }থএড়ইধপশ এমন অপরাধ যেটি সংগঠিত হয়নি এরূপ কারাদ-ে দ-নীয় অপরাধে সহায়তাকরণ সংক্রান্ত। এ ধারাটিতে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তির কারাদ-ে দ-নীয় কোনো অপরাধে সহায়তার ফলে উক্ত অপরাধ সংগঠিত না হয় এবং অনুরূপ সহায়তার শাস্তি বিধানার্থে এ বিধিতে কোনো স্পষ্ট ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে উক্ত অপরাধের জন্য ব্যবস্থিত যেকোনো বর্ণনার কারাদ-ে, যার মেয়াদ উক্ত অপরাধের জন্য ব্যবস্থিত দীর্ঘতম মেয়াদের এক-চতুর্থাংশ পর্যন্ত হতে পারে অথবা উক্ত অপরাধের জন্য ব্যবস্থিত অর্থদ-ে বা উভয় দ-ে দ-িত হবে।
যদি দুষ্কর্মে সহায়তাকারী বা সহায়তাকৃত ব্যক্তি এমন একজন সরকারি কর্মচারী হন, যার কর্তব্য হচ্ছে অপরাধ প্রতিরোধ করা, তাহলে সহায়তাকারী ব্যক্তি উক্ত অপরাধের জন্য ব্যবস্থিত যেকোনো বর্ণনার কারাদ-ে, যার মেয়াদ উক্ত অপরাধের জন্য ব্যবস্থিত দীর্ঘতম মেয়াদের অর্ধেক পর্যন্ত হতে পারে অথবা উক্ত অপরাধের জন্য ব্যবস্থিত অর্থদ-ে বা উভয় দ-ে দ-িত হবে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইয়াদ আলী, মুকিম আলীকে মিথ্যা স্বাক্ষ্য দেওয়ার জন্য প্ররোচণা দেয়। এক্ষেত্রে মুকিম আলী মিথ্যা স্বাক্ষ্য না দিলেও ইয়াদ আলী এ ধারায় বর্ণিত অপরাধ সংগঠনের জন্য দোষী হবে এবং তদানুসারে দ-িত হবে। অনুরূপ মুকিম আলী একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে তার সরকারি দায়িত্ব সম্পাদনকালে ইয়াদ আলীকে কিঞ্চিত অনুগ্রহ করার জন্য ইয়াদ আলী তাকে উৎকোচ প্রদানের প্রস্তাব করে। মুকিম আলী উৎকোচ গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। ইয়াদ আলী এ ধারা মতে দ-িত হবে।
ধারা নং ১১৬ এ বর্ণিত প্রথমোক্ত অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদ- হয়ে থাকলে তা ৩০ বছর গণ্যে এর এক-চতুর্থাংশ পর্যন্ত হতে পারে অর্থাৎ সাড়ে ৭ বছর পর্যন্ত হতে পারে, অপরদিকে উক্ত ধারায় বর্ণিত শেষোক্ত অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদ- হয়ে থাকলে তা ৩০ বছর গণ্যে এর এক-অর্ধাংশ পর্যন্ত হতে পারে অর্থাৎ ১৫ বছর পর্যন্ত হতে পারে। ধারা নং ৫১১ যাবজ্জীবন কারাদ-ে বা অন্য যেকোনো মেয়াদের কারাদ-ে দ-নীয় অপরাধসমূহ সংগঠনের প্রচেষ্টার শাস্তি সংক্রান্ত। এ ধারাটিতে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি এ বিধিবলে যাবজ্জীবন কারাদ-ে বা অন্য যেকোনো মেয়াদের কারাদ-ে দ-নীয় কোনো অপরাধ সংগঠন করার বা অনুরূপ অপরাধ সংগঠনের প্রচেষ্টা করে এবং অনুরূপ প্রচেষ্টায় উক্ত অপরাধ সংগঠনের অভিপ্রায়ে কোন কাজ করে, সে ব্যক্তির অনুরূপ প্রচেষ্টার শাস্তির ব্যাপারে এ বিধিতে কোনো স্পষ্ট বিধান না থাকলে উক্ত অপরাধের জন্য ব্যবস্থিত যেকোনো বর্ণনার কারাদ-ে যার মেয়াদ যাবজ্জীবন কারাদ-ের এক-অর্ধাংশ অথবা ক্ষেত্রবিশেষে উক্ত অপরাধের জন্য ব্যবস্থিত দীর্ঘতম মেয়াদের এক-অর্ধাংশ পর্যন্ত হতে পারে বা অনুরূপ অপরাধের জন্য ব্যবস্থিত অর্থদ-ে বা উভয় দ-ে দ-িত হবে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইয়াদ আলী একটি বাক্স ভেঙে কিছু গহনাপত্র চুরি করার চেষ্টা করে এবং অনুরূপভাবে বাক্স খোলার পর দেখে যে তাতে কোনো অলংকার নেই। ইয়াদ আলী চুরির সংগঠনের অভিপ্রায়ে কাজটি করেছে; অতএব, সে এ ধারার অধীনে দোষী। এ ধারার অধীন অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদ- হয়ে থাকলে তা ৩০ বছর গণ্যে এর এক-অর্ধাংশ বা অন্য যেকোনো অপরাধের কারাদ-ের ক্ষেত্রে ব্যবস্থিত দীর্ঘতম দ-ের এক-অর্ধাংশ পর্যন্ত হতে পারে অর্থাৎ প্রথমোক্ত ক্ষেত্রে ১৫ বছর পর্যন্ত এবং শেষোক্ত ক্ষেত্রে ব্যবস্থিত দীর্ঘতম দ-ের এক-অর্ধাংশ অর্থাৎ দীর্ঘতম দ- ১০ বছর হলে ৫ বছর পর্যন্ত হতে পারে।
দ-ের মেয়াদের অংশ হিসাব করার জন্য যাবজ্জীবন কারাদ-কে ৩০ বছরের কারাবাস ধরা হলেও সকল ক্ষেত্রে তা ৩০ বছর নাও হতে পারে। দ-প্রাপ্ত অপরাধীগণ কারান্তরীণ থাকাবস্থায় ভালো আচরণের জন্য কারা আইন (চৎরংড়হ অপঃ) ও কারাবিধি (ঔধরষ ঈড়ফব) অনুযায়ী সাজার মেয়াদের হ্রাস পান। যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত অপরাধীগণ এ ধরনের হ্রাস পেয়ে থাকলে তাদের ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন সাজা ৩০ বছর গণ্যে তা হতে হ্রাসকৃত সাজা বিয়োজনপূর্বক অবশিষ্ট যে সাজা থাকে রাষ্ট্রপতি বা সরকারকর্তৃক মার্জনার ক্ষেত্রে উক্ত সাজা হতে যাবজ্জীবন সাজার অংশ নির্ধারণ করা হয়। আশা করা যায়, দীর্ঘদিন যাবত নানা মহলে যাবজ্জীবন সাজা বিষয়ক যে অস্পষ্টতা ও ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে উপরোক্ত আলোচনা তা স্বার্থকভাবে নিরসনে সহায়ক হবে।
লেখক : সাবেক জজ ও রাজনৈতি বিশ্লেষক
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন
