আমেরিকার ব্যর্থ নেতৃত্ব
ডেভিড ব্রুকস, ইন্টারন্যাশনাল নিউইয়র্ক টাইমস: আমেরিকায় এখন ব্যর্থ নেতৃত্ব দেখা যাচ্ছে। রাজনীতি যেমন করে ক্রিয়াশীল হওয়ার কথা তেমন করে কাজ করছেনা। গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা হচ্ছে না।
এই ব্যর্থতার চরিত্র কী? এর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় দুর্নীতিকে। ওয়াশিংটনের হাত দিয়ে প্রচুর টাকা প্রবাহিত হচ্ছে। এর ফলে বিশেষ স্বার্থের লোকজন যা ইচ্ছে করতে পারছে। আর সকলেই তা অনুভব করতে পারছেন। ব্যর্থতার জন্য আরও যে বিষয়টিকে দায়ী করা হয় তা হলো সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। অভিজাতরা যে অঙ্গনে বসবাস করে, তার বাইরের জগৎ সম্পর্কে আর কোনো খোঁজ খবর রাখে না তারা। এ দুটো মতই আলোচনার দাবি রাখে।
এ বিষয়ে এখানে আরও গভীর আলোচনার অবকাশ রয়েছে। গত কয়েক দশকে শত শত ভালো মানুষ সরকারি কাজে বা রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে। তারা নিজেদের আবিষ্কার করেছে, একটা সিস্টেমের ভিতরে তারা চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে আছে। ওই সিস্টেমের পরিচালকরা তাদের নিজ স্বার্থে পরিচালনা করছে।
প্রথমে পেশা ও কাজের মধ্যে পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করা যাক। ক্যারিয়ার বা পরিকল্পনা ঋদ্ধ কাজ হলো সেটি, যা কেউ নিজের পছন্দে বেছে নেয়। পেশা হলো সেটি, যা অন্য কেউ ডেকে নিয়ে দেয়। ক্যারিয়ার সচেতন ব্যক্তি চিন্তা করেন কী করে তিনি সর্বোত্তম কাজটি করতে পারবেন অথবা কোন নির্বাচনে তিনি কী করে জিতবেন। আর পেশাদার ব্যক্তি চিন্তা করেন কী করে তার দক্ষতা সবচেয়ে ভালো কাজে ব্যয় করবেন। ক্যারিয়ার সচেতন কর্ম এমন একটি প্রক্রিয়া, যা খরচের চেয়ে বেশি লাভ চিন্তা করে। আর পেশাদার লোকেরা বিশেষ কিছু আঁকড়ে ধরে থাকে, এটাকে ধ্যান-জ্ঞান মনে করে এবং তার ব্যক্তিগত পরিচয়ের অংশ মনে করে।
পেশার সঙ্গে এক ধরনের আদর্শবাদিতা জড়িয়ে থাকে। এটা উপভোগ করার মতো একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আর কোনো সমস্যা দেখা দিলে বা সম্মানজনক মনে না হলে এটা ছেড়ে দেওয়া যায়। এটা অনেকটা দ্বৈত ন-অর্থক বিষয়।
এ ধারণাটাকে উন্মাসিক বলা যেতে পারে। তবে, এ কথাও ঠিক যে বেশিরভাগ মানুষ সরকারি কাজে বা রাজনীতিতে প্রবেশ করে এক ধরনের আদর্শবাদী আহ্বান থেকে। অর্থাৎ বেশিরভাগের উপর দেওয়া দায়িত্বই অন্যের দেওয়া। সরকারি কর্মকর্তাদের আশপাশে থাকলে অনুভব করা যায় যে, তারা হয়তো সরকারি কাজের চেয়ে বেসরকারি কাজে বেশি ভালো করতো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একটা সাধারণ গল্প শোনা যাবে যে, আর্তের সেবা করাই ছিল তাদের জীবনের উদ্দেশ্য।
বাস্তবতা হলো রাজনীতিকের জীবন ফুল বিছানো শয্যা নয়। সব সময় ক্ষমতাশালী হয়না বা আনন্দে পূর্ণও হয়না। বেশিরভাগ রাজনীতিকই তহবিল সংগ্রহের খেলায় দক্ষ হয় না। এটা একটা নোংরা দলীয় খেলা মাত্র। আর তারা তা করতে পারঙ্গম হয়ে উঠেন যখন তার পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পান।
গত কয়েক বছর ধরে বেশিভাগ রাজনীতিকই সিস্টেমের পাঁকে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন। পরামর্শকদের হিসাব নিকাশের প্যাঁচে আছেন তারা। জড়িয়ে আছেন ক্ষণজীবী গণমাধ্যমের বেড়াজালে। তারা বাঁধা পড়েছেন, সীমাহীন বৈঠকে, সভায়। চাপা পড়েছেন জনতার সমালোচনার নীচে। তাদের প্রচারণায় ব্যয় হচ্ছে অনেক বেশি সময়। এ কারণে তারা নীতি নিয়ে চিন্তার সময় পান না। তারা দলীয় চক্রের সেবায় এখন প্রথম সারিতে আছেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, হিলারি ক্লিন্টন প্রথমে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন শিশুদের কল্যাণে কাজ করবেন। কয়েক দশক পর তিনি দেখতে পান এটা বড় কঠিন কাজ। মিট রমনিকে একজন অসাধারণ মানুষ মনে হবে। যখন তিনি প্রচার কাজ করেন তখন তার প্রকৃত চরিত্র ঢাকা পড়ে রাজনৈতিক সূত্রের আড়ালে।
এমন পরিস্থিতির জন্যই হয়তো কবি ডেভিড হোয়াইট লিখেছিলেন, ‘কাজ, বিয়ের মতো, এমন একস্থান যেখানে তুমি হারিয়ে যেতে পারো, ফিরে পেতে পারো আরও সহজে নিজেকে, — হারাতে পারো তোমার অনুভব, তোমার নিজস্ব কন্ঠস্বর, ভুলে যেতে পারো নিজের ভূমিকার কথা, প্রতিশ্রুতির কথা, যা তুমি নিজেকে দিয়েছিলে এক দিন’
এ মত হয়তো সকলের বেলায় একভাবে প্রযোজ্য নয়। তবে উচ্চাকাঙ্খা সবসময়ই কাজের ধারণাকে ছাড়িয়ে যায়। আর রাজনীতিকরা ক্যারিয়ারিস্ট ধারণাকে সব সময় ভয়ের দৃষ্টিতে দেখেন। তারা সব সময় হেরে যাওয়াকে ভয় পান। এমনকি কোনো ইতিবাচক আদর্শবাদিতার চেয়ে ব্যর্থতাকে ভয় পান বেশি। এমন ধাঁচের মানুষ সব সময় স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনায় তাড়িত হন। তারা ভুলে যান তাদের অতীত স্বপ্নের কথা। তারা এমন পরিস্থিতিতে যুক্তি দেখান যে, বিরোধী পক্ষ যখন এতটা খারাপ তখন তাদের কি-ই বা করার আছে। তারা মনে করেন তাদের সব কর্মই দেশের সেবা। এটা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য হয়তো খারাপ নয়, তবে পুরো পদ্ধতির জন্য ক্ষতিকর। আর পেশাদার মনোভাবাপন্ন মানুষ সবসময় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় দৃষ্টি নিবন্ধ করেন। তারা তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে চান স্বপ্ন দিয়ে। লক্ষ্য অর্জনে তারা থাকেন অবিচল আর স্থিতধী। অন্যদিকে ক্যারিয়ারিস্টরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেকে রক্ষা করে চলেন। তারা আর, আগে করা হয়েছে এমন কিছু করতে চান না।
বলা চলে সব মানুষই পেশাদার মনোভাব নিয়ে কর্ম শুরু করে। তারা তাদের অন্তরের ডাকে কাজ শুরু করে। এর পর সাফল্যের দৌড় শুরু হয়। তাদের পেয়ে বসে ব্যক্তি সাফল্যের উচ্চাকাঙ্খা। একসময় তারা অনুভব করে তাদের প্রচেষ্টার যুক্তিহীনতা। তখন তারা তাদের প্রকৃত আদর্শবাদে ফিরতে চায়। আর আদর্শবোধ তাড়িত পেশাদারিত্বে ফেরা হয়তো অসম্ভব নয়। ফিরতে পারছেনা বলেই নেতৃত্বে দেখা যাচ্ছে ব্যর্থ মুখচ্ছবি। অনুবাদ : মোহসীন আব্বাস