
ধর্ম পালনের উদ্দেশ্য কি?
কৃষ্ণ কান্ত বৈরাগী
ধর্ম পালনের উদ্দেশ্য কি? সাধারণ জ্ঞানে ইহকালে মঙ্গল ও মৃত্যুর পরে স্বর্গ বা সদৃশ কোনো স্থানে গমন । কিন্তু সেটা কেন হবে? সাধারণ বর্ণনায়, এই স্থানটির যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে ভোগ-বিলাস, এমনকি দেহগত সুখসহ আড়ম্বর পূর্ণ সময় পার করার সুযোগ সেখানে রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
এটা কি কাক্সিক্ষত হতে পারে? পৃথিবীতে ধর্ম পালন, সংযমী জীবনযাপন, সৎ জীবনযাপন, ভোগ-বিলাস পরিহার প্রভৃতি কিভাবে একটি চূড়ান্ত ভোগ-বিলাসের আশায় হতে পারে? মূর্খ বানরকে কলার লোভ দেখিয়ে নাচানো যেতে পারে।
কিন্তু জ্ঞানী মানুষ কি লোভের বশবর্তী হয়ে ধর্ম পালন করতে পারে! আসলে বিষয়টি সেরকম নয়ও। মানুষ তার জ্ঞানের স্তর অনুসারে কর্ম সম্পাদন করে আর সেই কর্ম অনুসারেই ভগবান তাকে ফল প্রদান করেন। শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতায় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,
যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম।
মম বর্ত¥ানুবর্ততে মনুষ্যা পার্থ সর্বশঃ।।
(৪র্থ অধ্যায় ১১তম শ্লোক)
অর্থাৎ যে আমাকে যেভাবে ভজনা করে আমি তাকে সেভাবেই তুষ্ট করি।
আসলে ধর্ম পালনের বিনিময়ে কিছু চাওয়াটা মূর্খতা। তারপরও মানুষ নিজের জ্ঞান তথা পারমার্থিক স্তর অনুসারে ধর্ম পালনের পদ্ধতি বেছে নেয় এবং স্বর্গলোক, ধন-দৌলত, বিদ্যা-বুদ্ধি, রোগ মুক্তি, যশ-প্রতিপত্তি, সন্তানাদি প্রার্থনা করে আর ভগবানও কর্মানুসারে ফল প্রদান করেন। এই কর্মফল ভোগের জন্যই জন্ম-মৃত্যুরূপ শৃঙ্খলে আবদ্ধ থেকে জগৎ সংসারে আবর্তিত হতে হয়।
অজ্ঞানী ব্যক্তি জানেই না যে তার চাওয়া কি হওয়া উচিৎ বা চাওয়া নিষ্প্রয়োজন। তাই তার আকাক্সক্ষা পূরণকেই পরম প্রাপ্তি মনে করে। আদতে ডোবার ব্যাঙের মতোই সে তার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবগত নয়। আবার কেউ কেউ উচ্চতম পারমার্থিক স্তরে পৌঁছতে না পেরে অথবা গভীরতম জ্ঞান অনুধাবনের সামর্থ্য না থাকার কারণে কিংবা মহাসমুদ্রের মতো বিশাল জ্ঞান ভা-ারের কূল-কিনারা করতে না পেরে শিয়াল প-িতের মতো রণে ভঙ্গ দেয়।কিন্তু যিনি প্রকৃত ধার্মিক ও যথার্থ জ্ঞানী তিনি তার প্রকৃত কর্তব্য সম্পর্কে অবগত। তাইতো তিনি কোনো চাওয়া-পাওয়ার ধার ধারেন না। তিনি অনন্য ভক্তিতে ভগবানের সেবা করে যান। শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতায় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন,
ভক্ত্যা ত্বনন্যয়া শক্য অহমেবং বিধোহর্জুন।
জ্ঞাতুং দ্রষ্টুং চ তত্ত্বেন প্রবেষ্টুং চ পরন্তপ।।
(১০ম অধ্যায় ৫৪ তম শ্লোক)
অর্থাৎ হে অর্জুন! হে পরন্তপ! অনন্য ভক্তির দ্বারাই আমাকে তত্ত্বত জানতে, প্রত্যক্ষ করতে এবং আমার চিন্ময় ধামে প্রবেশ করা যায়।
মৎকর্মকৃন্মৎপরমো মদ্ভক্তঃ সঙ্গবর্জিত।
নির্বৈরঃ সর্বভূতেষু যঃ স মামেতি পান্ডব।।
(১০ম অধ্যায় ৫৫ তম শ্লোক)
অর্থাৎ হে অর্জুন যিনি আমার অকৈতব সেবা করেন, আমার প্রতি নিষ্ঠাপরায়ণ, আমার ভক্ত, জড় বিষয়ে আসক্তি রহিত, সর্বভূতে শত্রুভাব রহিত, তিনিই আমাকে লাভ করেন।
শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতায় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে চূড়ান্ত উপদেশ দিয়ে বলেছেন,
সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ ।।
(১৮ম অধ্যায় ৬৬ তম শ্লোক)
অর্থাৎ সর্বপ্রকার ধর্ম পরিত্যাগ করে কেবল আমার শরণাগত হও। আমি তোমাকে সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব। তুমি শোক করো না।
যিনি প্রকৃত জ্ঞানী ভক্ত তিনি সমস্ত রকম আকাক্সক্ষা রহিত। এমনকি তিনি ভগবানকে লাভের বা তার চিন্ময়ধামে গমনের আশাও করেন না। তিনি সর্বাবস্থায় শুধু ভগবানের প্রীতির জন্য কাজ করেন, তার সেবা করেন।
অর্থাৎ তার দেহ-মন সর্বদা ভগবানে নিবিষ্ট থাকে। আর ভগবান তখন তাকে তার নিত্য সেবক করে নেন। তখন তাকে আর জন্ম -মৃত্যু, জড়া-ব্যাধির শৃঙ্খলে আবর্তিত হতে হয় না অর্থাৎ তিনি মহামুক্তি লাভ করেন।
