রবিন কুমার সাহা : শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায়ে ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ নামক দুটি ভিন্ন শক্তির কথা উল্লেখ রয়েছে। ক্ষেত্র বলতে বোঝায় এ জড় দেহকে, আর এ জড় দেহকে যিনি জানেন তিনিই ক্ষেত্রজ্ঞ নামে অভিহিত। আমরা আমাদের শরীর সম্পর্কে জানি। ‘আমি মানুষ’, ‘আমি ডাক্তার’, ‘আমি ব্যবসায়ী’, ‘আমি খুব সুন্দর’Ñ দেহ সম্পর্কে এ রকম জ্ঞান আমাদের সবার আছে। সে হিসেবে আমরা এই শরীরের ক্ষেত্রজ্ঞ। তবে সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে দেখা যায় যে, আমরা আসলে কিছুই জানি না। এমনকি আমাদের দেহ সম্পর্কেও কিছু জানতে পারি না। সামান্য রোগে এমনকি ডাক্তারকেও দেহ পরীক্ষা করতে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে দৌড়াতে হয়।
তবু আমরা দাবি করি, আমরা সব জানি! দেহের মতো বৃহৎ বস্তুর কথা বাদ দিলাম, আমরা আমাদের মনকে কতটুকু জানতে পারি। মনের খেয়ালে আমরা কতকিছুই করে থাকি, যার ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তারপরও আমরা কিন্তু আমাদের দেহের ক্ষেত্রজ্ঞ।
ক্ষেত্রজ্ঞ হিসেবে আমাদের জ্ঞান এ ক্ষেত্রের (শরীর) ভেতরই সীমাবদ্ধ। আমাদের পাশাপাশি অবস্থান করা অন্য ক্ষেত্র সম্পর্কেও আমরা কিছু জানি না। কোনো স্বামী বলতে পারে না যে, সে তার স্ত্রী সম্পর্কে সবকিছু জানে। তেমনি পিতা-মাতা বলতে পারে না যে, তারা তাদের সন্তান সম্পর্কে সবকিছু জানে। সুতরাং যতগুলো ক্ষেত্র রয়েছে, ততগুলোই পৃথক পৃথক ক্ষেত্রজ্ঞও রয়েছে। এমন একজন নিশ্চয়ই রয়েছে যিনি সমস্ত ক্ষেত্র ও ক্ষেত্র হতে পৃথক ক্ষেত্রজ্ঞ সম্পর্কেও জ্ঞান রাখেন। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায়ের তৃতীয় শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, ‘আমাকে সমস্ত ক্ষেত্রের ক্ষেত্রজ্ঞ বলে জানবে।’
এ সম্পর্কে শ্রীল প্রভুপাদ বলেন, ‘পরমেশ্বর ভগবান যিনি পরমাত্মা রূপে প্রত্যক শরীরে বর্তমান, তিনি সমস্ত শরীর সম্বন্ধে সর্বতোভাবে অবগত। তিনি দেবতা, মানুষ, পশু, কীট, পতঙ্গ, বৃক্ষ, লতা আদি সমস্ত প্রজাতির শরীর সম্বন্ধেই সর্বতোভাবে অবগত। কোনো নাগরিক যেমন শুধু তার নিজের জমিটি সম্বন্ধেই অবগত, কিন্তু রাজা কেবল তার রাজপ্রাসাদ সম্বন্ধেই অবগত নন, তিনি তার রাজ্যের প্রতিটি নাগরিকের সমস্ত সম্পত্তি সম্বন্ধেও অবগত। রাজা হচ্ছেন তার রাজ্যের মুখ্য মালিক এবং নাগরিকেরা হচ্ছেন গৌণ মালিক।’
তবে আমাদের সমস্যা হচ্ছে এই যে, আমাদের মধ্যে কেউ কেউ আমাদের নিজেকেই মালিক ভেবে থাকি যদিও আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই। আবার কেউ কেউ সেই সর্বক্ষেত্রজ্ঞকে বৃহদাকৃতি ভাবতে ভাবতে এত বৃহৎ করে ফেলে যে, তাকে আর কোনো আকার দিতে পারে না। আবার যদি কেউ পূর্বতন মহর্ষিদের অনুমোদিত পন্থানুযায়ী সেই সর্বক্ষেত্রজ্ঞের ভাবগ্রাহী মনুষ্যরূপ সম্পর্কে চিন্তা করে, তখন সে সমস্ত নিরাকারবাদীরা তাদের নিন্দা-মন্দ করতে থাকে।
কেননা নিরাকারবাদীদের চিত্তে সে রকম ভাবনা আসতেই পারে না, তারা ভাবে ‘আমাদের দেহ ও ইন্দ্রিয়সমূহ যেহেতু সীমাবদ্ধ, তাই সর্বক্ষেত্রজ্ঞ (ভগবান)-এর দেহও সীমাবদ্ধ হবে।’ তারা ভগবানকে অতিরিক্ত সম্মান করতে গিয়ে, নিজের সীমিত ক্ষমতার সঙ্গে তুলনা করার মতো বড় অপরাধ করে ফেলছেন, সেটা তারা স্বীয় জ্ঞানের অহঙ্কার বলে বুঝতেই পারে না।