
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব লক্ষণ
চারুচন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী
শ্রীকৃষ্ণের গর্ভ-প্রবেশ সাধারণ শিশুর মতো নয়
ইতোপূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে যে, ভগবান এ জগতে আবির্ভাবের পূর্বেই তার পার্ষদদের প্রেরণ করেন। একইভাবে শ্রীকৃষ্ণ প্রেরণ করেছিলেন তার পিতামাতারূপ নিত্য পার্ষদ নন্দ-যশোদা এবং দেবকী-বসুদেবকে। দেবকীর অষ্টম সন্তানরূপে সমস্ত সৃষ্টির অধীশ্বর গোলোকবিহারী পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কংসের কারাগারে প্রথমে তার পরম ভক্ত বসুদেবের হৃদয়ে প্রবিষ্ট হন। তারপর বসুদেবের হৃদয় থেকে দেবকীর হৃদয়ে প্রবিষ্ট হন, ঠিক যেভাবে অস্তগামী সূর্যের রশ্মি উদীয়মান চন্দ্রে প্রবেশ করে। অশ্বত্থামা কর্তৃক নিক্ষিপ্ত ব্রহ্মাস্ত্র থেকে পরীক্ষিত মহারাজকে সুরক্ষা প্রদানকালে শ্রীকৃষ্ণ যখন উত্তরার গর্ভে প্রবেশ করেছিলেন, তখন তাকে কোনো পিতার আশ্রয় অবলম্বন করতে হয়নি। এর দ্বারা শ্রীকৃষ্ণ এটাই প্রমাণিত করেছেন যে, দেবকীর গর্ভে প্রবেশ করার জন্য তাকে একটি সাধারণ শিশুর মতো পিতার আশ্রয় অবলম্বন করতে হয়নি। যেহেতু তিনি সবকিছুর মূল কারণ, সর্বব্যাপ্ত, অবিচ্ছিন্ন পরমাত্মা, তাই তিনি বাহ্য ও অন্তরশূন্য। তিনি কখনও দেবকীর গর্ভে প্রবেশ করেননি; পক্ষান্তরে তিনি পূর্বেই সেখানে বিদ্যমান ছিলেন (অনাবৃতত্বাৎ বহিঃ অন্তরম্ ন তে সর্বস্য সর্ব-আত্মনঃ আত্মবস্তুন ॥Ñভা.১০/৩/১৭)। তার অচিন্ত্য শক্তির প্রভাবে ভগবান যেকোনোভাবে জন্মগ্রহণ করতে পারেন। ইতোপূর্বে সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ভগবান সকলেরই হৃদয়ে বিরাজমান, ঠিক যেমন সূর্য সকলের মাথার উপর যুগপৎ বিরাজ করে। সূর্য কোটি কোটি মানুষের মাথার উপরে থাকলেও তার অর্থ এই নয় যে, আলাদা আলাদাভাবে অবস্থিত। তেমনি, ভগবান তার অচিন্ত্য শক্তির প্রভাবে প্রত্যেকের হৃদয়ে বিরাজ করতে পারেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। একত্বমনুপশ্যতঃ (ঈশোপনিষদ ৭)।
এভাবে যেহেতু তিনি তার পূর্ণশক্তিসহ দেবকীর হৃদয়ে বিরাজমান ছিলেন, তাই তিনি তার দেহের বাইরেও আবির্ভূত হতে পারেন। শ্রীমদ্ভাগবতে (১/৮/১৮) কুন্তীদেবী তার প্রর্থনায় বলেলনÑ অলক্ষ্যং সর্বভূতানাম্ অন্তর্বহিরবস্থিতম্ ॥ অর্থাৎ, তিনি সকলের অন্তরে এবং বাইরে অবস্থিত, তথাপি তাকে কেউ দেখতে পায় না। এমনকি, যদি আমরা বসুদেবের মতো শুদ্ধসত্ত্বে অধিষ্ঠিত হতে পারি, তবে আমাদের হৃদয় থেকেও তিনি আবির্ভূত হতে পারেন। সুতরাং আবির্ভূত হওয়ার জন্য তাকে একজন সাধারণ মানুষের মতো পিতাকে আশ্রয় করে কোনো স্ত্রীর গর্ভে প্রবেশ করতে হয় না। তবুও, বাৎসল্য রস আস্বাদন করানোর জন্য তিনি যদি তার কোনো ভক্তকে পিতামাতারূপে আশ্রয় করেও আসেন, তথাপি তার পরমেশ্বরত্বের হানি হয় না, বরং তাতে তার সর্বশক্তিমত্তা, বৈরাগ্য, ভক্তের প্রতি করুণা আর মহত্ত্বই বৃদ্ধি পায়।
দেবকী শ্রীকৃষ্ণেরই বিস্তার
ব্রহ্মসংহিতায় (৫/৩৭) উল্লেখ করা হয়েছে যে, শ্রীকৃষ্ণ এবং তার পরিকরেরা চিন্ময় তত্ত্ব (আনন্দচিন্ময়রস)। শ্রীকৃষ্ণের পিতা, মাতা, গোপসখা, গাভী এবং অন্য সমস্ত বিস্তার, সকলেই চিন্ময় তত্ত্ব যা ব্রহ্মবিমোহন লীলায় আমরা দেখতে পাই। ব্রহ্মা যখন শ্রীকৃষ্ণের পরমেশ্বরত্ব পরীক্ষা করার জন্য শ্রীকৃষ্ণের গোপসখা এবং গোবৎসদের হরণ করেছিলেন, তখন ভগবান বহু গোপবালক এবং গোবৎসরূপে নিজেকে বিস্তার করেছিলেন, যাদের ব্রহ্মা বিষ্ণুমূর্তিরূপে দর্শন করেছিলেন। দেবকীও শ্রীকৃষ্ণেরই বিস্তার এবং তাই শ্রীমদ্ভাগবতের ১০/৩/৮ শ্লোকে বলা হয়েছেÑ দেবক্যাং দেবরূপিণ্যাং বিষ্ণুঃ সর্বগুহাশয়ঃ।
শ্রীমদ্ভাগবতে কোনো কোনো শ্লোকে দেবরূপিণ্যাম্ শব্দটির পরিবর্তে বিষ্ণুরূপিণ্যাম্ শব্দটির ব্যবহার হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই এই শব্দটির অর্থ হচ্ছে যে, দেবকীর রূপ ভগবানেরই মতো চিন্ময়। ভগবান সচ্চিদানন্দবিগ্রহ এবং দেবকীও সচ্চিদানন্দবিগ্রহ। তাই সচ্চিদানন্দবিগ্রহ ভগবানের দেবকীর গর্ভে আবির্ভূত হওয়ার বিষয়ে কোনো ত্রুটি দর্শন করা যায় না।
শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবকলীন সর্বসুলক্ষণযুক্ত গ্রহ নক্ষত্র
যখন শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের সময় হলো, তখন কাল সর্বগুণ সমন্বিত হয়ে পরম সুন্দর হয়ে উঠল এবং পৃথিবীও আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। তিথি, যোগ এবং নক্ষত্র তখন সর্বমঙ্গলময় এবং সর্বসুলক্ষণ যুক্ত হয়ে উঠল এবং সর্বসুলক্ষণযুক্তা রোহিণী নক্ষত্র তখন তুঙ্গে প্রকাশিত হলো। পূর্ণচন্দ্র যেভাবে উদিত হয়, ঠিক সেভাবেই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হলেন। কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে, শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হয়েছিল অষ্টমী তিথিতে, তাহলে পূর্ণচন্দ্রের উদয় হলো কী করে? এর উত্তরে বলা হয়েছে যে, শ্রীকৃষ্ণ চন্দ্রবংশে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাই চন্দ্র সেই রাতে অপূর্ণ থাকলেও সেই বংশে ভগবানের আবির্ভাবের ফলে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে সেদিন পূর্ণ হয়ে উঠলেন। ‘খমাণিক্য’ নামক জ্যোতিষ-শাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থে ভগবানের আবির্ভাব সময়কালীন গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান খুব সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। সেখানে প্রমাণ করা হয়েছে যে, এই শুভ মুহূর্তে যে শিশুটির জন্ম হলো, তিনি হলেন পরম-ব্রহ্ম।
মনুষ্যশিশু চতুর্ভুজ রূপ নিয়ে অলঙ্কারসহ দিব্য সাজে সজ্জিত হয়ে জন্মগ্রহণ করে না
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রাতের গভীর অন্ধকারে চতুর্ভুজ বিষ্ণুরূপ ধারণ করে দেবকী-বসুদেবের সম্মুখে আবির্ভূত হলেন। বসুদেব দেখলেন যে, সেই কমলনয়ন অদ্ভুত শিশুটি চতুর্ভুজ। তিনি তার চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা এবং পদ্ম ধারণ করে আছেন (তম্ অদ্ভুতম্ বালকম্ অম্বুজ-ইক্ষণম্ চতুর্ভুজম্Ñভা.১০/৩/৯)। বক্ষে তার শ্রীবৎস চিহ্ন, কণ্ঠে কৌস্তুভ শোভিত কণ্ঠহার, পরণে পীতবসন, উজ্জ্বল মেঘের মতো তার গায়ের বর্ণ, বৈদুর্য মণিভূষিত কিরীট তার মস্তকে শোভা পাচ্ছে, নানারকম মহামূল্যবান মণি-রতœ শোভিত সমস্ত অলঙ্কার তার দিব্য দেহে শোভা পাচ্ছে, তার মাথাভর্তি কুঞ্চিত কালো কেশরাশি। শিশুটির অঙ্গকান্তিতে সেই ঘর উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। এই অদ্ভুত শিশুটিকে দেখে বসুদেব প্রথমে খুব আশ্চর্য হলেন। তিনি ভাবলেন, কীভাবে একটি নবজাত শিশু এরকম সমস্ত অলঙ্কারে ভূষিত হলো? তাই তিনি বুঝতে পারলেন যে, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণই তার পুত্ররূপে আবির্ভূত হয়েছেন। কোনো মনুষ্যশিশু এভাবে চতুর্ভুজ রূপ নিয়ে অলঙ্কার এবং সবরকম দিব্য সাজে সজ্জিত হয়ে পরমেশ্বর ভগবানের সমস্ত লক্ষণযুক্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। তাই বসুদেবের মনে আর কোনো সংশয় রইল না যে, এ নবজাত শিশুটিই হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান, তখন তিনি করজোড়ে প্রণিপাত করে তার বন্দনা করেছিলেন।
দেবকী ও বসুদেব শ্রীকৃষ্ণকে তাদের পুত্ররূপে কামনা করেছিলেন
তারপর মাতা দেবকীও পরমেশ্বরের নিকট প্রার্থনা করেন। দেবকীর প্রার্থনা শুনে ভগবান বললেন, ‘হে মাতা, স্বায়ম্ভুব মনুর সময় আমার পিতা বসুদেব সুতপা নামে একজন প্রজাপতি (প্রজাদের পতি বা নিয়ন্তা) ছিলেন, আর আপনি ছিলেন পৃশ্নি নামে তার পতœী। সে সময় ব্রহ্মা প্রজা বৃদ্ধি করার আকাক্সক্ষায় আপনাদের সন্তান উৎপাদন করতে অনুরোধ করেন। তখন আপনারা আপনাদের ইন্দ্রিয় সংযম করে দেবতাদের গণনা অনুসারে ১২,০০০ বছর ধরে কঠোর তপস্যা করেছিলেন এবং একাগ্রচিত্তে আমার আরাধনায় নিমগ্ন হয়েছিলেন। তখন আমি অত্যন্ত প্রসন্ন হয়ে আপনাদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার জন্য এ রূপ নিয়েই আবির্ভূত হয়েছিলাম। যদিও আপনি তখন আমাকে সাক্ষাৎ দর্শন করেছিলেন, তবুও আমার মায়ার প্রভাব থেকে মুক্তি প্রার্থনা না করে আপনি কেবল আমাকে আপনার পুত্ররূপে কামনা করেছিলেন। এভাবে তার পিতা-মাতার সঙ্গে কথা বলে ভগবান নিজেকে একটি ছোট্ট সাধারণ মনুষ্য শিশুতে পরিণত করলেন। আর এভাবেই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার দিব্য জন্মলীলা প্রকাশ করেন। উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয় যে, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার চিন্ময় ধামে সর্বদা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও সাধুদের পরিত্রাণ, দুষ্কৃতকারীদের বিনাশ, ধর্মসংস্থাপন এবং সর্বোপরি তার ভক্তদের আনন্দবিধান ও লীলা বিস্তারের জন্য অন্তরঙ্গ পার্ষদসহ যুগে যুগে এ জগতে অবতীর্ণ হন। সেই আদিপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ কোনো সাধারণ শিশুর মতো জন্মগ্রহণ করেন না; তিনি তার দিব্য শাশ্বত রূপ নিয়েই আবির্ভূত হন। তখন তিনি কারো প্রভু, কারো সখা, কারো পুত্র বা কারো প্রেমিক অথবা পতিরূপে লীলাবিলাস করেন। তাই কাউকে পিতামাতারূপে গ্রহণ করা সত্ত্বেও তিনি পরমব্রহ্ম পরমেশ^র ভগবান বলেই জগতে কীর্তিত হন। সাধারণ সম্পাদক, ইস্কন বাংলাদেশ
