জন কেরির সফরের দিকেই সবার দৃষ্টি
দীপক চৌধুরী: মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির আসন্ন বাংলাদেশ সফরের দিকে এখন সবার দৃষ্টি। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী হামলা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে তা প্রতিরোধে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানই এ সফরের আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে বলে মনে করা হলেও রাজনৈতিক বিষয়ে তিনি ‘গুরুত্বপূর্ণ’ আলোচনা করবেন বলে একাধিক কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে।
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন প্রধান এজেন্ডায় থাকলেও গণতন্ত্র, উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও মানবাধিকার ইস্যুও যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারে রয়েছে। ওয়াশিংটনে কেরির ঢাকা ও দিল্লি সফরসংক্রান্ত এক ঘোষণায় একথা বলা হয়েছে। জন কেরির এ সফর নানা কারণেই তাৎপর্যপূর্ণ।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘনিয়ে এলেও জন কেরি সফরে বাংলাদেশে আসছেন। এছাড়াও এমন এক সময় বাংলাদেশ সফরে আসছেন তিনি, যখন মৃত্যুদ-াদেশপ্রাপ্ত অন্যতম শীর্ষ ও প্রভাবশালী যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শুরু হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীচক্র এ বিচার ও রায় ঠেকাতে আন্তর্জাতিকপর্যায়ে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করেছিলেন।
এর আগে ২০১৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর দ্রুত ইতিবাচক সংলাপে বসার অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে চিঠি দিয়েছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি।
জন কেরি ২৯ আগস্ট একদিনের সফরে ঢাকায় এলেও থাকবেন ১২ ঘণ্টার চেয়েও কম সময়। তিনি একটি বিশেষ বিমানযোগে এ সফরে আসছেন। কেরি ঢাকায় আসার আগেই অর্থাৎ আজ ঢাকায় পৌঁছবেন ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে জন কেরির এটি প্রথম ঢাকা সফর হলেও গত পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এটি দ্বিতীয় ঢাকা সফর। ২০১২ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন দুদিনের সফরে ঢাকায় আসেন। হিলারি বাংলাদেশ সফর শেষে ভারতে গিয়েছিলেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, জন কেরি এমন এক সময় ঢাকায় আসছেন, যখন বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদী হামলা বেড়ে গেছে। বিভিন্ন দেশ ও জোটের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে ওবামা প্রশাসন।
গুলশানে জঙ্গিহামলার পর বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন দেশের উদ্বেগের পরও তার এ সফরের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের গণমাধ্যম সম্পর্কবিষয়ক কার্যালয়ের পরিচালক এলিজাবেথ ট্রুডো গত বৃহস্পতিবার কেরির বাংলাদেশ সফরের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার দীর্ঘমেয়াদি ও বিস্তৃত সম্পর্ক আরও জোরদার করার লক্ষ্য নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি আগামী ২৯ আগস্ট ঢাকায় আসছেন। বিভিন্ন বৈশ্বিক বিষয়ে দুদেশের ক্রমবর্ধমান সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেরি বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এছাড়া গণতন্ত্র, উন্নয়ন, নিরাপত্তা এবং মানবাধিকার বিষয়ে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্ব আরও শক্তিশালী করার ওপরও তিনি জোর দেবেন। গত জুনে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব সংলাপে আইএস ও আল-কায়দার মতো জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে একযোগে কাজ করতে সম্মত হয় দুই দেশ। কেরির সফরকালে বাংলাদেশের কাউন্টার টেরোরিজম পার্টনারশিপ ফান্ডেও (সিটিপিএফ) বাংলাদেশের যোগ দেওয়ার ঘোষণা আসতে পারে।
এদিকে জন কেরির সফরের প্রস্তুতির লক্ষ্যে একটি অগ্রবর্তী দল গত রোববার রাতে ঢাকায় এসেছে। ঢাকা সফরকালে জন কেরি যেসব স্থানে যাওয়ার কথা রয়েছে সেগুলো পরিদর্শন করেছে প্রতিনিধি দল। কেরির নিরাপত্তা নিয়ে এ প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কেরির গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হোসেন মাহমুদ আলীর সঙ্গে হবে আনুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় বৈঠক। এছাড়া কেরির সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার একটি এবং জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদের বৈঠক হতে পারে। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও কেরির বৈঠক হবে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বিবৃতিতে আরও বলা হয়, আগামী ২৯-৩১ আগস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেরি ভারতের নয়াদিল্লি সফর করবেন। সেখানে তিনি ভারতের ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। ৩০ আগস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেরি এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রী পেনি প্রিস্কার যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের মধ্যকার দ্বিতীয় কৌশলগত ও বাণিজ্যিক সংলাপে (স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড কমার্শিয়াল ডায়ালগ- এসএন্ডসিডি) নিজ দেশের নেতৃত্ব দেবেন।
জানা গেছে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করবে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ)। কেরির সফর উপলক্ষে রাজধানী ঢাকায় নিñিদ্র নিরাপত্তার আয়োজন করা হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে একটি সাংবাদিক প্রতিনিধি দল আসছে। মার্কিন সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহে সহায়তার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র অনুরোধ জানিয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আসন্ন বাংলাদেশ সফর স্বল্প সময়ের জন্য হলেও এর মাধ্যমে ওয়াশিংটনের কাছে ঢাকার গুরুত্বের প্রতিফলন ঘটছে। জন কেরি বাংলাদেশ সফরে আসবেন বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে কথা দিয়েছিলেন। তার বর্তমান মেয়াদের শেষদিকে হলেও এ সফরের মাধ্যমে তিনি সেকথা রাখছেন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ‘অত্যন্ত ক্রটিপূর্ণ’ হিসেবে অভিহিত করে আলোচনার ভিত্তিতে দ্রুত একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নতুন নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ৫ জানুয়ারির সেই নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখনো আগের অবস্থানেই আছে। তবে এ নির্বাচন ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এ সম্পর্ক বড় কোনো বাধার সৃষ্টি করেনি, বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিকশিত হয়েছে।
সন্ত্রাসবিরোধী জোরালো অবস্থান থাকা সত্ত্বেও ২০১৪ সালে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বৈশ্বিক সামরিক জোটে যোগ দেয়নি বাংলাদেশ। বাংলাদেশ জাতিসংঘের অধীনেই কেবল শান্তিরক্ষা উদ্যোগে অংশ নেয়। যুক্তরাষ্ট্র জোটে টানার চেষ্টা করলেও বাংলাদেশের জোরালো যুক্তি ছিল বাংলাদেশ তার সেনাদের যুদ্ধ করতে বিদেশে পাঠায় না।
গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিহামলার প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে ফোন করে সন্ত্রাস নির্মূলে বাংলাদেশকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার কথা জানান তিনি।
জন কেরির বাংলাদেশ সফরকে বড় ঘটনা বলে মনে করেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রচেষ্টাকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে বলেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের এ সফর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। কেরির সফর স্বল্প সময়ের জন্য হলেও এর তাৎপর্য ও বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে বলে মন্তব্য করেন ওয়ালিউর রহমান। সম্পাদনা: মোরশেদ