বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ফাদার হোমরিক সিদ্ধান্ত বদলে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাচ্ছেন
জেমস গমেজ
সুদীর্ঘ ৬১ বছর মিশনারি জীবন কাটিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ফাদার ইউজিন হোমরিক, (৮৮) সিএসসি নিজ দেশ যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাচ্ছেন। ফাদার হোমরিক ছিলেন এ বাংলার অতি আপন মানুষ। তিনি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। পেয়েছেন মুক্তিযোদ্ধার সম্মাননা।
জন্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হলিক্রস পুরোহিত ফাদার হোমরিককে বিদায় জানাতে পীরগাছা সেন্ট পৌল ধর্মপলীøতে গত ১২ আগস্ট বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। সেখানে ফাদার ইউজিন হোমরিক এত দীর্ঘ সময়ে তাঁর পাশে থাকা প্রাণের মানুষদের উদ্দেশে বলেন, শিক্ষা হচ্ছে জাতির মেরুদ-। তাই ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দিতে হবে। এর পাশাপাশি নৈতিক গুণাবলি অক্ষুণœ রাখতে হবে। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। সেই সঙ্গে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য অর্থনৈতিক কর্মকা-ে সম্পৃক্ত হতে হবে।
বিভিন্ন গ্রাম থেকে আদিবাসীরা অনুষ্ঠানে যোগ দেন। প্রধান অতিথি ছিলেন ময়মনসিংহ ক্যাথলিক ধর্মপ্রদেশের বিশপ পল পনেন কুবি, সিএসসি। উপস্থিত ছিলেন ময়মনসিংহ-১ আসনের সাংসদ জুয়েল আরেং, হলিক্রস সম্প্রদায়ের এদেশীয় প্রধান (প্রভিন্সিয়াল) ফাদার জেমস ক্রজ, পীরগাছা ধর্মপল্লীর পাল পুরোহিত ফাদার ইউজিন আনজুস, আদিবাসী নেতা ইউজিন নকরেক প্রমুখ।
এদিকে ৯ আগস্ট আদিবাসী দিবসের কর্মসূচিতে মধুপুর ও ধনচাড়ী আসনের (টাঙ্গাইল-১) এমপি ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক ফাদার হোমরিকের নানা অবদানের প্রশংসা করেন। একইসঙ্গে তিনি ফুলেল শুভেচ্ছায় ফাদারকে বিদায় জানান। যাজকীয় জীবনের ৫০ বছরে ২০০৫ সালের ৩০ অক্টোবরে অনুষ্ঠিত ওয়ানগালায় তাকে বিশেষভাবে অভিনন্দিত করে মান্দি গারোরা। ২০১৫ সালের ১৫ নভেম্বর একই অনুষ্ঠানে দেয়া হয় হীরকজয়ন্তীর অভিনন্দন। উভয় অনুষ্ঠানে হোমরিকের শেষদিন পর্যন্ত মান্দি গারোদের সঙ্গে কাটানোর ইচ্ছা প্রকাশ পেয়েছিল। কিন্তু শেষ অনুষ্ঠানের এক বছরের মাথায় আবিমা (ধর্ম অঞ্চল) তথা এদেশ ত্যাগ করে ফিরে যাচ্ছেন নিজ দেশে। মূলত বয়স আর সাম্প্রতিক নিরাপত্তাজনিত সমস্যা তাকে ফিরে যেতে পথ দেখিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জার্মান পিতা বার্নার্ড হোমরিক ও অস্ট্রেলিয়ান মাতা ইলা ভেলির সন্তান ইউজিন ই. হোমরিকের জন্ম ১৯২৮ সালের ৮ ডিসেম্বর। তখন তার বাবা-মা থাকতেন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের মুসরিগন নামক স্থানে। ছয় ভাই বোনের মধ্যে চতুর্থ ইউজিন হোমরিক বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্জন করে খ্রিস্ট ধর্মে ব্রত নিয়ে যাজক হন এবং বাংলাদেশে আসেন। ১৯৫৫ সালে বাংলাদেশে এসেই তিনি নটরডেম কলেজের তৎকালীন বাংলার অধ্যাপক মিয়া মোহাম্মদ আবদুল হামিদের কাছে বাংলা ভাষার পাঠ নেন। ১৯৫৬ সাল থেকে ৩ বছর ঢাকার নবাবগঞ্জের গোল্লা ধর্মপল্লীতে কাজ করে ময়মনসিংহ শহর ও হালুয়াঘাটে বদলি হন। হালুয়াঘাটের বিড়ইডাকুনিতে ৯ মাস অবস্থান করে ১৯৬০ সালে চলে আসেন টাঙ্গাইলের মধুপুর বনাঞ্চলে।
জলছত্র মিশনের দায়িত্ব নিয়েই তিনি উপলব্ধি করেনÑ দারিদ্র্যই হচ্ছে গারো আদিবাসীদের নিত্যসঙ্গী। তাদের ঘরে সারা বছর খাবার থাকে না, রোগেশোকে সর্বদাই জর্জরিত ও শিক্ষার আলো থেকে মারাত্মকভাবে বঞ্চিত। বিশুদ্ধ পানীয় জল ও স্যানিটেশনের সুযোগ-সুবিধা তাদের নেই। তাই তিনি এই মান্দি জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে বনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে তোলেন ৩৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। জলছত্র এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন কর্পোস খ্রিস্টি উচ্চ বিদ্যালয় এবং পীরগাছায় প্রতিষ্ঠা করেন সেন্ট পৌলস উচ্চ বিদ্যালয়। মান্দি ছেলেদের জন্য দুটি ছাত্রাবাস ও মান্দি মেয়েদের জন্য দুটি ছাত্রীনিবাস স্থাপন তাঁর অনন্য কীর্তি। আদিবাসী সম্প্রদায়ের বিশুদ্ধ পানির অভাব দূরীকরণে তিনি কূপ, নলকূপ ও গভীর নলকূপ স্থাপন করেন। তাদের আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির সংস্পর্শে নিয়ে আসার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। তিনি নিজেও কৃষি ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেছেন। জলছত্র অঞ্চল আদিবাসী মান্দি সম্প্রদায়ের জন্য জীবনযাত্রা কিছুটা সহজ করে গড়ে তুলে তিনি ১৯৯২ সালে মধুপুর জঙ্গলের আরো গভীরে পীরগাছা নামক স্থানে এসে নতুন বসতি স্থাপন করেন। তখন শোলাকুড়ী ইউনিয়নের এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে না ছিল কোনো পাকা রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ সংযোগ বা হাট-বাজার। তিনি নিজ উদ্যোগে এখানে শিক্ষার আলো ছড়াতে প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।