সরকারি আইসিইউর অভাবে প্রাণ যাচ্ছে অনেকের
রিকু আমির: সরকারিভাবে দেশে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) চিকিৎসাসুবিধা সীমিত। হাতেগোনা যে ক’টি হাসপাতালে এ সুবিধা রয়েছে, সেসব হাসপাতাল থেকে সময়মতো এটি পাওয়া দুষ্কর। ফলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে অনেক রোগী। বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় এ সুবিধা থাকলেও বেশ ব্যয়বহুল। নিম্নআয়ের রোগীর পক্ষে আকাশচুম্বী এ ব্যয় বহন করা অসম্ভব। তাছাড়া অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ চিকিৎসাসেবা দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্নবিদ্ধ। অভিযোগ আছে, আইসিইউ’র নামে উচ্চহারে চিকিৎসা ফি আদায় করছে অনেক বেসরকারি হাসপাতাল। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসুবিধা ও উপকরণ ছাড়াই চলছে রাজধানীর অনেক বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ।
রাজধানীর মিরপুরবাসী মো. বেলাল দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। তাকে সাড়ে ১১ নম্বর সেকশনের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার অবস্থার অবনতি ঘটে। প্রয়োজন পড়ে আইসিইউ। কিন্তু ওই হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা ছিল না। তাকে স্থানান্তর করা হয় মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালে। সেখানে নেওয়ার পথেই তার মৃত্যু ঘটে। শুধু মো. বেলাল নন, এভাবে আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় আইসিইউ চিকিৎসা না পেয়ে ঝরছে শত শত গরিব মানুষের প্রাণ। আবার আর্থিক সঙ্গতি থাকলেও সময়মতো আইসিইউ না পেয়ে মারা যাচ্ছেন বিত্তবান কিংবা বিশিষ্ট মানুষও। আর উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে এ ধরনের সমস্যায় পড়লে বিত্তবানদের পক্ষেও আইসিইউ সুবিধা পাওয়া সম্ভব হয় না। দরিদ্র রোগীর অবস্থা তো আরও কষ্টের।
বিশেষজ্ঞরা জানান, আইসিইউ হচ্ছে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র। এতে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস যন্ত্র, হার্ট মনিটরসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি থাকে। এখানে মুমূর্ষু রোগীকে চিকিৎসা দেন অ্যানেসথেসিয়া, এনালজেসিয়া ও ইনটেনসিভ কেয়ার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। আর ইমার্জেন্সি চিকিৎসা বলতে দুর্ঘটনা বা অপঘাতের রোগীর জীবন রক্ষায় তাৎক্ষণিক চিকিৎসা। এ ক্ষেত্রে অক্সিজেন, ওষুধ, ছোটখাটো অপারেশন, রক্ত ও আইভি স্যালাইনের ব্যবস্থা থাকে। আইসিইউ চিকিৎসার ব্যয় অনেক বেশি। এটি চালু করতেও অনেক টাকার প্রয়োজন। ১০ বেডের একটি আইসিইউ চালু করতে কমপক্ষে ২ কোটি টাকা লাগে। অভিজ্ঞ চিকিৎসক, নার্সও নিয়োগ দিতে হয়। তাই ছোটখাটো হাসপাতালে এ ধরনের চিকিৎসাব্যবস্থা থাকে না।
বিশেষজ্ঞরা জানান, দুর্ঘটনায় রোগীদের চেতনা থাকা অবস্থায় শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে পাঁচ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে এবং অ্যাজমা বা অন্য কোনো রোগের কারণে এমনটি হলে দু-এক ঘণ্টা বিলম্বে মেডিসিন বা আইসিইউ সেবা পেলেও রোগী বেঁচে যান। সড়ক দুর্ঘটনাসহ যেকোনো অপঘাতে জ্ঞান হারানোর পর মানুষের শরীরে মাত্র তিন থেকে পাঁচ মিনিট অক্সিজেন থাকে। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে ইমার্জেন্সি মেডিসিনের নাগাল খুব কম মানুষই পান।
অভিযোগ উঠেছে, প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত মেডিকেল উপকরণ ও ওষুধের পরিমাণ দেখিয়ে বিল বাড়িয়ে দেওয়া হয়। পর্যাপ্তসংখ্যক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রাখা হয় না। দু’তিনটি বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে সব রোগের চিকিৎসা করানোর ব্যবসা চালানো হয়। অনেক হাসপাতালে আইসিইউর শতকরা ৭০ ভাগ শয্যার সঙ্গে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র নেই। শতকরা ৬০ ভাগ আইসিইউতে প্রতিটি শয্যার জন্য একজন করে সেবিকা নেই। আর যারা আছেন, তাদের শতকরা ৬৪ ভাগের প্রশিক্ষণ নেই। খরচ করেও কিছু হাসপাতালে সেবা পাওয়া যায় না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানেসথেসিয়া, অ্যানালজেসিয়া অ্যান্ড ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, আইসিইউতে রোগীকে উঠানো-নামানো, কাত করাসহ বিভিন্ন অবস্থানে রাখার জন্য বিশেষায়িত শয্যার দরকার। প্রত্যেক রোগীর জন্য পৃথক ভেন্টিলেটর (কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র) ও কার্ডিয়াক মনিটর (হৃদযন্ত্রের অবস্থা, শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা, কার্বন-ডাই অক্সাইড নির্গমনের মাত্রা, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি, রক্তচাপ পরিমাপক), ইনফিউশন পাম্প (স্যালাইনের সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মাত্রা নির্ধারণ যন্ত্র) দরকার। আইসিইউতে শক মেডিশন (হৃদযন্ত্রের গতি হঠাৎ থেমে গেলে তা চালু করার যন্ত্র), সিরিঞ্জ পাম্প (শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে যে ওষুধ প্রবেশ করানো হয় তার মাত্রা নির্ধারণের যন্ত্র), ব্লাড ওয়ার্মার (রক্ত দেওয়ার আগে শরীরের ভিতরকার তাপমাত্রার সমান করার জন্য ব্যবহৃত যন্ত্র) থাকবে। পাশাপাশি কিডনি ডায়ালিসিস মেশিন, আল্ট্রাসনোগ্রাম, এবিজি মেশিন (মুমূর্ষু রোগীর রক্তে বিভিন্ন উপাদানের মাত্রা নির্ধারণ) থাকতে হবে। তারা বলেন, জরুরি পরীক্ষার জন্য আইসিইউর সঙ্গে একটি পরীক্ষাগার থাকাও আবশ্যক বলে জানান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
জটিল রোগের চিকিৎসায় ও জরুরি প্রয়োজনে আইসিইউর সেবা নিতে হয়। চিকিৎসকরাও এ সেবার কথা ব্যবস্থাপত্রে লিখেন। কিন্তু খরচ করেও কিছু হাসপাতালে সেবা পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ উঠেছে। অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অভিযোগ করেন, বর্তমানে আইসিইউ একটি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। আইসিইউগুলোকে কিভাবে চালাচ্ছে, তা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিয়মিত নজরদারিতে থাকা উচিত। রাজধানীর নামী হাসপাতালগুলোতে আইসিইউর দৈনিক খরচ ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং মাঝারি হাসপাতালগুলোতে খরচ ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা বলা হলেও তার দ্বিগুণ টাকা দিতে হয় রোগীকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক দীন মো. নূরুল হক জানান, দেশের প্রতিটি মেডিকেল কলেজসহ জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপন সরকারি বিবেচনায় রয়েছে। জেলা সদর পর্যায়ের হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসকরা উদ্যোগী হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতি হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপন করা যাবে। এজন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহে সার্বিক সহযোগিতা করবে সরকার। সম্পাদনা: মোরশেদ