‘সিøপার সেল’ থেকেই আত্মঘাতী হামলা চালাচ্ছে জঙ্গিরা
আমিনুর রহমান তাজ : বিশ^জুড়ে জঙ্গি কার্যক্রমে নতুন মাত্রা যোগ করছে ‘সিøপার সেল’। শীর্ষ জঙ্গি সংগঠন ‘আল কায়েদা’ (এআই) ও ‘ইসলামি স্টেটস (আইএস) এর জঙ্গিরা এই ‘সিøপার সেলে’ অবস্থান করেই বিশ^জুড়ে আত্মঘাতী হামলা চালাচ্ছে। এর ফলে অশান্ত হয়ে উঠেছে বিশ্বের অনেক দেশ।
প্রতিদিনই জঙ্গিদের আত্মঘাতী হামলার শিকার হচ্ছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অনেক নাগরিক। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সিএনএন এক প্রতিবেদনে বলেছে, গত ২৮ মে থেকে ৫ জুন বিশে^র পাঁচটি দেশে জঙ্গিদের আত্মঘাতী হামলায় মারা গেছে পৌনে ৩শ’ নাগরিক। প্রতিটি হামলার সঙ্গে শীর্ষ জঙ্গি সংগঠন আইএস জড়িত। আইএস নিজেও এসব হামলার দায় স্বীকার করে ‘আমাক নিউজ এজেন্সি’ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের’ ওয়েবসাইটে বিবৃতিও ছেপেছে।
সিআইএ’র সাবেক কর্মকর্তা ব্রুস রিদেল বলেছেন, ইরাক ও সিরিয়ার যুদ্ধে বিপর্যয়ের পর আইএস বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা বিশ^জুড়ে তাদের জঙ্গি কর্মকা- বিস্তৃত করেছে।
২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল আমেরিকার বোস্টনে ম্যারাথন রেসে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় রাশিয়ান দুই ভাইয়ের জড়িত থাকার ঘটনাটি তদন্ত করতে গিয়ে জঙ্গিদের ১২টি সিøপার সেলের তথ্য পায়। সিøপার সেলগুলো শনাক্ত করতে ১ হাজার এফবিআই অ্যাজেন্টকে মাঠে নামায় মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি দফতর।
২০১৫ সালের নভেম্বরে ফ্রান্সের প্যারিসে আত্মঘাতী হামলার পর দেশটির গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ‘সিøপার সেল’ এর সন্ধান পায়। ওই হামলায় ১৩০ জন ফরাসি নাগরিক মারা যান। আত্মঘাতী ওই হামলার নায়ক সালাহ আবদেসলাম’কে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলন’র মোলেনবিক জেলার একটি সিøপার সেল থেকে আটক করেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা। সালাহ আবদেসলাম ওই সিøপার সেলে ১২০ দিন আত্মগোপন করেছিলেন।
সিআইএ’র পরিচালক জন ব্রিনান বলেছেন, আইএস যোদ্ধারা কেবল মধ্যপ্রাচ্যেই নয়, পশ্চিম আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে সক্রিয় রয়েছে।
২০০৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইভেস্টিগেশন (এফবিআই) জানায়, ৪০টি রাষ্ট্রে আল কায়েদার সিøপার সেল রয়েছে। এই সেলগুলোতে অবস্থান করে তারা জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
ব্রিটেনের মিরর পত্রিকা এক প্রতিবেদনে বলেছে, আইএস’র দলত্যাগী নেতা আবু খালেদ তাদের বলেছেন, সিরিয়া ও ইরাকে আইএস-এর কয়েক হাজার যোদ্ধার বিপর্যয়ের পর দলের নেতারা নতুন ‘স্ট্র্যাটেজি’ অবলম্বন করেছেন। এটি হচ্ছে- ইউরোপে শতাধিক ‘সিøপার সেল’ খোলা হয়েছে। এই সেলগুলো অবিলম্বে তাদের জঙ্গি তৎপরতা শুরু করবে।
আবু খালেদ মিরর পত্রিকার সাংবাদিক মিচেল উইচকে বলেছেন, আইএস প্রধান আবু বকর আল বাগদাদী তার যোদ্ধাদের বলেছেন, ঘরের ভেতরেই যুদ্ধ শুরু করতে। আইএস চাচ্ছে তাদের অনুগত জঙ্গিরা নিজ নিজ দেশেই থাকুক। তারা নাগরিকদের হত্যা করুক এবং ভবন উড়িয়ে দিক। আবু খালেদ এও বলেছেন, আইএস সারা বিশে^ তাদের জঙ্গি সদস্যদের ‘সিøপার সেলে’ অবস্থানের নির্দেশ দিয়েছে।
২০১৫ সালে ঢাকার একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী- রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে জঙ্গিদের ১০০ সিøপার সেল রয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রকে উদ্ধৃত করে পত্রিকাটি বলেছে, ৩ থেকে ৭ জন জঙ্গি সিøপার সেলে অবস্থান করে ইসলামের বিরুদ্ধ ব্যক্তিদের হত্যা করছে। অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যার পর গোয়েন্দারা ‘সিøপার সেলের’ অস্তিত্ব খুঁজে পায়। বাবু হত্যার পর জনতা জিকরুল্লাহ ও আরিফুল ইসলাম নামে দুই যুবককে হাতেনাতে আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। পরে তদন্তে প্রকাশ পায়- সন্দেহভাজন ওই দুই জঙ্গি সিøপার সেলে অবস্থান করে ব্লগার অভিজিৎ ও বাবুকে হত্যা করে।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) এক জঙ্গি বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে ইংরেজি দৈনিকটি আরও বলেছে- রাজধানীতে অনেক ‘সিøপার সেল’ রয়েছে, যেখানে অবস্থান করে জঙ্গিরা প্রশিক্ষণ নিয়ে হত্যাকা-গুলো সংঘটিত করছে। এটা খুবই রহস্যজনক যে ‘এক সিøপার সেলে’ অবস্থানরত জঙ্গিরা অন্য সেল সম্পর্কে কিছুই অবহিত নয়। কিলিং মিশনগুলো পরিচালনার জন্য ‘সিøপার সেলের’ বাংলাদেশের জঙ্গিরা সাধারণত দেশীয় ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করছে বলে পত্রিকাটি উল্লেখ করেছে।
২০০৪ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এই সিøপার সেল এর সদস্যরা ১৬ জনকে হত্যা করেছে। গোয়েন্দা সূত্রগুলো পত্রিকাটিকে আরও জানিয়েছে, বিদেশ থেকে নির্দেশ না আসা পর্যন্ত এই জঙ্গিরা ব্যবসায়ী অথবা ছাত্রের ছদ্মবেশে বছরের পর পর অচেনা লোকজনদের মধ্যে বসবাস করছে।
র্যাব গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুল কালাম আজাদ ইংরেজি দৈনিকটিকে বলেছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘সিøপার সেল’র সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত কট্টরপন্থী দল হরকাতুল জিহাদ (হুজি), আনসারউল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), জামায়াতুল মুজাহিদিন (জেএমবি) ও হিজবুত তাহরীর (এইচটি) এর বেশ কয়েকটি দল ‘সিøপার সেলে’ অবস্থান করছে বলেও পত্রিকাটিকে জানান ওই র্যাবের গোয়েন্দা কর্মকর্তা। মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক নেতা পরামর্শে এই সেলগুলো তাদের জঙ্গি কর্মকা- পরিচালনা করে আসছে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই বড় বড় জঙ্গি সংগঠনগুলোর সিøপার সেল রয়েছে। এছাড়া গত ১ জুলাই ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী রোহান ইমতিয়াজসহ ৬ জঙ্গি ছিল সিøপার সেলের সদস্য। ভারতের হায়দ্রারাবাদ ও পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশে জঙ্গিরা সিøপার সেল খুলেছে। আল কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটস এই সিøপার সেলগুলো পরিচালনা করছে। এই সেল থেকেই জঙ্গিরা আত্মঘাতী হামলা চালাচ্ছে।
রাজধানী ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি স্প্যানিশ রেস্তোরাঁয় হামলার সঙ্গে জড়িত জঙ্গিদের সবাই বাংলাদেশি নাগরিক। এরা সবাই মেধাবী ও অভিজাত পরিবারের সন্তান বলে জানা গেছে। জঙ্গিরা সবাই পরিবার থেকে অনেক আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে সিøপার সেলে অবস্থান করছিল বলে গোয়েন্দাদের ধারণা। এই সিøপার সেল থেকেই ইন্টারনেটে যোগায়োগ হয় আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর হাইকমা-ের সঙ্গে। সেখান থেকে নির্দেশ আসার পরই হলি আর্টিজানে হামলা চালায় তারা।
১৯৯৮ সালে তানজিনিয়ার দারেস সালামে ও কেনিয়ার নাইরোবিতে মার্কিন দূতাবাসে যে বোমা হামলা চালানো হয়, তার সঙ্গে আল কায়েদা ও ইসলামি জিহাদ সংগঠনের যেসব জঙ্গিরা জড়িত ছিল তারা আফ্রিকার সিøপার সেল থেকেই হামলাগুলো পরিচালনা করে বলে মার্কিন গোয়েন্দা তদন্তে প্রকাশ পায়। ওই দুই হামলায় দুই শতাধিক লোক নিহত হয়। আহত হয় ৪ সহস্রাধিক।
২০১৬ সালের এপ্রিলে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেলহেগেনে পুলিশ জঙ্গিদের সিøপার সেল ধ্বংস করে দেয়। অস্ত্রসহ গ্রেফতার করা হয় ৪ সন্দেহভাজন জঙ্গিকে। তারা পশ্চিমা স্থাপনার উপর হামলার পরিকল্পনা করছিল বলে ডেনমার্কের গোয়েন্দা সংস্থা ‘পেট’ জানায়। সম্পাদনা: আ. হাকিম