রামপালের বিরোধিতা ও গুলশানে হামলার ষড়যন্ত্র একই : প্রধানমন্ত্রী
দীপক চৌধুরী : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাগেরহাটের রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবন ও পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না। দেশের উন্নয়নের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য যা কিছু ভালো মনে হবে, আমি সেগুলো করবই।’
গতকাল শনিবার গণভবনে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ সুন্দরবন ও পরিবেশের ক্ষতি করবে না বলে বিভিন্ন তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের দাবিও নাকচ করে দেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করার জন্য এখন আন্দোলন? উন্নয়নের গতি শ্লথ করে দেওয়াই এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য।’
রামপাল বিদ্যুৎকন্দ্রের বিরোধিতার সঙ্গে গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার তুলনাও করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘যারা এ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে কথা বলছেন, তাদের উদ্দেশ্যটা কী? উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করা। হলি আর্টিজান বেকারিতে হত্যাকা-ের শিকার হন ঢাকার মেট্রোরেল প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এমন বেশ কয়েকজন জাপানি নাগরিক। ওই হামলা করা হয়েছিল বাংলাদেশের উন্নয়ন ও বিনিয়োগ থামাতে। দুটি তুলনা করলে বেশি তফাৎ দেখা যায় না।’ রাজনৈতিকভাবে ‘দেউলিয়াদের’ অপপ্রচারে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বানও জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি।
রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরোধিতা করে বিভিন্ন বাম রাজনৈতিক দল ও সংগঠন আন্দোলন করে আসছে। এর মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও সংবাদ সম্মেলন করে এ প্রকল্প বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপারসনের সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যকে উদ্ভট, বানোয়াট ও ?অসত্য বলে উল্লেখ করে বলেন, ‘খালেদা জিয়া জনগণকে বিভ্রান্ত করতে ও দেশের উন্নয়নে বাধা দিতে এ ধরনের কথা বলছেন।’ তিনি খালেদা জিয়ার উপস্থাপন করা বিভিন্ন তথ্য সঠিক নয় বলে উল্লেখ করেন।
১ হাজার ৮৩৪ একর জমির ওপর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপিত হবে বলে বিএনপি চেয়ারপারসন দাবি করলেও তা নাকচ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আসলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জায়গা নেওয়া হয়েছে ৯১৫ একর। এর মধ্যে ৪৬৫ একরে মূল বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকবে। বাদবাকি জায়গায় সোলার প্যানেল বসবে এবং সবুজায়ন করা হবে।’
আট হাজারের বেশি মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়েছে বলে খালেদার দাবি নাকচ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে এলাকাটিতে মানুষের কোনো স্থায়ী বসতি ছিল না। কোনো বসতি উচ্ছেদ করা হয়নি। নিচু পতিত জমি মাটিভরাট করে উঁচু করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপির এ অপপ্রচারে প্রকাশ্যে যোগ দেওয়ার পেছনে গভীর কোনো ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে যদি কোনো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই থাকত, তাহলে তারা অনেক আগেই তা জনসমক্ষে প্রকাশ করত।’ তিনি বলেন, ‘এত দিন ধরে চলে আসা আন্দোলনের পেছনে বিএনপি ছিল।’
১৭৭টি সংগঠন ভারতের এক্সিম ব্যাংককে বলেছে, রামপালে অর্থায়ন না করতে। এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে একজন সাংবাদিকের করা প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কেউ অর্থ না দিলে নিজেদের টাকায় করা হবে। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুর কাজও নিজস্ব অর্থায়নে হচ্ছে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘খালেদা জিয়া বলেছেন, সেখানকার জমি তিন ফসলি। খালেদা জিয়ার দেওয়া অন্যান্য তথ্য যেমন ঘনত্ব, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা, জমির পরিমাণ সবই ভুল। তিনি কোথা থেকে, কার কাছ থেকে এ ধরনের তথ্য পেয়েছেন, তা বোধগম্য নয়।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যে ৭০ শতাংশ ঋণ ভারতের এক্সিম ব্যাংক দিচ্ছে, বাংলাদেশ কেবল সেই ঋণের জামিনদার (গ্যারান্টার)। বাংলাদেশে প্রকল্প হচ্ছে। তাই ভারতের জামিনদার হওয়ার কোনো কারণ নেই। বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে লাভের অর্ধেক পাবে ভারত। বিদ্যুৎ? কিনবে বাংলাদেশ। সেই বিদ্যুৎ? কী হবে, তা বাংলাদেশ নির্ধারণ করবে। এখান থেকে ভারত কোনো বিদ্যুৎ নিচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগ সবসময় উন্নয়নের জন্য সংগ্রাম করেছে। জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেছে। এ দলের লক্ষ্য মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা। সরকার জনগণের সেবক, এটা আওয়ামী লীগই কাজের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে।’
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে দেশের উন্নয়নবিরোধী একটি মহল মানুষকে মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করছে বলে অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা এতদিন খোঁজার চেষ্টা করছিলাম, এর পেছনে শক্তিটা কোথায়? এতদিন পরে আমরা দেখলাম, খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করে এ অপপ্রচারে সংহতি প্রকাশ করেছেন।’
প্রধানমন্ত্রী জানান, পরিবহন সহজলভ্যতা ও বসত-বাড়ি স্থানান্তর প্রভৃতি বিষয় বিবেচনা করে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জায়গা নির্বাচন করা হয়েছে। কিন্তু অনেকে অজ্ঞতাবশত সমালোচনা করছেন। যারা সমালোচনা করছেন, বিশেষ করে বিএনপিনেত্রী যখন কথা বলেন, তখন আমার মনে হয়, মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও বিদ্যুৎসচিব মনোয়ার ইসলাম।
শুরুতেই সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করেন প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। তারপর রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে একটি তথ্যচিত্র উপস্থাপন করেন বিদ্যুৎ বিভাগের পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন।
বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড’।
প্রকল্পে সহায়তা করছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও ভারতের এনটিপিসি লিমিটেড। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৫১০ কোটি টাকা।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্পের জন্য ৪৩০ একর ভূমির উন্নয়নকাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া চলছে প্রাথমিক অবকাঠামোর কাজ।
পরিবেশের বিশেষ করে সুন্দরবনের ক্ষতি হতে পারে এমন বক্তব্য সামনে এনে বিভিন্ন সংগঠন রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প নির্মাণের বিরোধিতা করছে। বামপন্থি দলগুলোর এ বিরোধিতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও। সম্পাদনা: মোরশেদ