প্রতিটি গ্রাম হোক, একটি পাঠাগার ১
বৃহৎ মঙ্গলের জন্য সমষ্টিকে নিয়ে কোনো কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার নামই আন্দোলন। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের বাস গ্রামে। এই গ্রামের মানুষেরাই আমাদের উৎপাদক শ্রেণি। কিন্তু সমাজে এই উৎপাদক শ্রেণিই আজকে সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত ও অবহেলিত। তাদের এই বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তি দিতে বাইরে থেকে ধার করে আনা কিংবা চাপিয়ে দেওয়া উন্নয়ন মডেলে সম্ভব নয়, তা আজ স্পষ্ট। অপরদিকে শহরের মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতা, বিলাসিতা, সকলকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা বা পরস্পর বিচ্ছিন্নতা ক্রমেই বাড়ছে। সে কারণে আমাদের সমস্যা ও সম্ভাবনাগুলো কোনো দিকনির্দেশনা পাচ্ছে না। কারণ আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতা, পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি মোটা দাগে চিহ্নিত করতে পারি, যা রোগের মতো সমাজে ছড়াচ্ছে। অথচ পরম আদরের সঙ্গে তাকেই আমরা লালন করছি। আত্মবিলাসি এই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে এসে সমষ্টিকে নিয়ে বৃহৎ-এর মাঝে নিজেকে যুক্ত করে সকলের মঙ্গলের জন্যই চাই এক বৃহৎ আন্দোলন। আমরা তার নাম দিতে চাই ‘গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন’।
২০০৬ সালে ৭ জন মিলে শুরু করি অর্জুনা অন্বেষা পাঠাগারের কার্যক্রম। পরে যোগ দেন আরও অনেকে। এরই মধ্যে নদী ভাঙন, পানি বৃদ্ধিতে অনেক মানুষ অসহায়। মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই। ভ্রমণ দল বিটিইএফ এর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। তারাও সহযোগিতা করতে চাইছিল দুর্গত মানুষদের। আমি আমার নিকট আত্মীয় দুজনের সাহায্য চাই। তাদের বলি, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তালিকা করে দিতে। তারা একটা তালিকা করে। তালিকার বেশিরভাগ নাম ছিল একটা বিশেষ রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকদের। আবারও তালিকার উদ্যোগ নিই। পাঠাগারের সদস্যরা রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তালিকা করেন। এই কাজে নেমে নতুন এক অভিজ্ঞতা হয়Ñ আমাদের তরুণেরা অপেক্ষাকৃত নির্মোহভাবে কাজ করতে পারে।
সহযোগিতার অর্থের পরিমাণ ছিল পঞ্চান্ন হাজার। আমার মত ছিল, প্রতি পরিবারকে ১ হাজার করে টাকা দিতে। কিন্তু তালিকায় অনেকের নাম থাকায় আমরা সমস্যায় পড়ে যাই। এক হিসাব বা গবেষণা করে বের করেন, যদি ৫০০ টাকা করে দিই তাহলে ১১০টি পরিবারকে আমরা সহযোগিতা করতে পারব, এই টাকা তাদের কাজেও আসবে। তৎকালীন বাজার মূল্য অনুযায়ী ৩০০ টাকায় ৫ কেজি জালা (ধানের চারাগাছের স্থানীয় নাম) পাওয়া যেত, যা থেকে ৮-১০ মণ ধান পাওয়া যাবে। ৪ সদস্যের একটি পরিবার যা দিয়ে অনায়াসে ১ মাস দুবেলা খাবার নিয়ে দুচিন্তা করতে হবে না। বাকি ২০০ টাকা সার ও জমি পরিচর্যার কাজে লাগবে।
যাদের এই অর্থ সহযোগিতা আমরা দেব, তাদের প্রতি আমাদের কঠিন শর্ত ছিলÑ এই টাকা দিয়ে অবশ্যই কৃষিকাজ করতে হবে। পাঠাগারের সদস্যরা এ ব্যাপারে নজর রাখে। প্রায় ৮০ ভাগ লোক এ টাকার সঠিক ব্যবহার করেন আর বাকি ২০ ভাগ লোক আর্থিক অনটনের কারণে ওই টাকা অন্যখাতে খরচ করে ফেলেন। ফসল ওঠার পর তারা নিজেরাই বলেছিলেন, গড়ে ১০ মণ করে ধান পেয়েছিলন। আর ওই ধান থেকে যে খড় হয়েছিল তার মূল্যই হবে প্রায় ৫০০ টাকা।
২০০৭ সালে সিডর আঘাত হানে বিস্তীর্ণ দক্ষিণ অঞ্চলে। পাঠাগারের পক্ষ থেকে আমরা তাদের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিই। সদস্যরা গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ৩ হাজার টাকা ও ৫ মণ চাল উঠায়। কিন্তু বিপদ হয়, এসব আমরা পাঠাব কিভাবে? উপজেলা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে সরকারের ত্রাণ তহবিলে জমা দিই। কিন্তু মনে সন্দেহ জাগে, এসব সহযোগিতা কি যথাসময়ে যথাযথ লোকের কাছে পৌঁছবে?
তখন আমরা চিন্তা করি, চিন্তায় পড়ি। ভাবি, যদি আমাদের এলাকার মতো ওই এলাকায়ও পাঠাগারের মতো একটি সংগঠন থাকত, তাদের সঙ্গে যদি যোগাযোগ থাকত তাহলে এই সামান্য সহযোগিতাও এই বিপদের দিনে অনেক বড় উপকারে আসত। আমাদের এই ভাবনা শেয়ার করি, ঢাকার র্যামন পাবলিকেশনের রাজন ভাইয়ের সঙ্গে। উনি আমাদের আশ্বাস দেন। ভরসা দিয়ে বলেন, যত বই লাগবে নিয়ে যাবেন, লজ্জা করবেন না। আমরা লেগে যাই নানা জায়গায় পাঠাগার স্থাপনের কাজে। কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চাঁদপুর, নাটোর, বদলগাছি, মধুপুর, সখিপুর, ভূঞাপুরসহ নানা জায়গায় আমাদের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠতে থাকে পাঠাগার। বিছিন্নভাবে যে পাঠাগারগুলো গড়ে উঠছে, আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকি। খাগড়াছড়ির অরং পাঠাগার এরকম একটি পাঠাগার। আমরা জোটবদ্ধভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি নাম নিই ‘গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন’।
পাঠাগারগুলো গড়ে উঠে স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে। এলাকার প্রয়োজন, চাহিদা, ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে স্থানীয়রাই সিদ্ধান্ত নেন কী হবে তাদের কর্মপরিকল্পনা। কেমন হবে তাদের কার্যপদ্ধতি। জেলা ও থানা পর্যায়ে সাধারণ পাঠাগার থাকায় সেসব পাঠাগার হয় বিশেষ ধরনের পাঠাগার। এরকমই একটি পাঠাগার হলো, লাইসিয়াম গণিত ও বিজ্ঞান সংঘ। যেখানে আয়োজন করা হয় বিজ্ঞানের নানা সেমিনার, কর্মশালা, ম্যাথ অলিম্পিয়াড, বিজ্ঞানমেলাসহ নানা ধরনের আয়োজন। পর্ব-০১
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন