পাইকারি ও খুচরা বিক্রয়ে মূল্যের এতবেশি ফারাক কেন?
বিভিন্ন জেলা বা অঞ্চলের কৃষকরা সাধারণত তাদের উৎপাদিত পণ্য একটি নির্ধারিত স্থানে বিক্রয়ের জন্য জড়ো করে এবং সেখান হতে পাইকাররা সুলভ মূল্যে পণ্য ক্রয় করে দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান দেয়। এ সকল পণ্যবাহী ট্রাক চলার পথে বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিভিন্ন নামধারী শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্যদের চাঁদার প্রতিবন্ধকতায় পড়ে।
বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত সংবাদ হতে জানা যায়, দেশের অন্য কোনো স্থান হতে এরূপ পণ্যবাহী ট্রাক ঢাকায় প্রবেশ করতে চাইলে সে চিত্রটিও ভিন্নতর নয়। আবার রাজধানী শহর ঢাকাকে অতিক্রম করে দেশের একপ্রান্ত হতে অন্যপ্রান্তে পণ্য পরিবহনকালে অধিক সংখ্যক স্থানে চাঁদা দিয়ে পার পেতে হয়। এ ধরনের চাঁদাবাজি দেশের কোনো আইন দ্বারা অনুমোদিত নয়। এ চাঁদাবাজির টাকা যদিও ট্রাক ড্রাইভার বা পণ্যের মালিক পরিশোধ করে কিন্তু পরিশেষে চাঁদার জন্য পণ্যের যে মূল্য বৃদ্ধি ঘটে এর অতিরিক্ত অর্থ ভোক্তাকে গুণতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ট্রাক মালিক বা ট্রাক ড্রাইভাররা পণ্যের গন্তব্যের ভিত্তিতে চাঁদাসহ ট্রাকভাড়া নির্ধারণ করে থাকেন। আবার অনেক সময় পণ্যের মালিক বা তার প্রতিনিধি পণ্যের সঙ্গে ট্রাকে থাকলে তারা চাঁদার অর্থ প্রদান করে থাকেন। এরূপ ক্ষেত্রে ট্রাকভাড়া থেকে চাঁদাবাজির টাকা বাদ দিয়ে ট্রাকভাড়া নির্ধারণ করা হয়।
দেশে কৃষিজাত পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ ধান, চাল, আলু, বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি, গম, ভুট্টা, দুধ, মাছ, বিভিন্ন মসলা জাতীয় পণ্য, হাঁস-মুরগি, ডিম, দেশিয় ফলমূল প্রভৃতি। এ সকল কৃষিজাত পণ্য একজন কৃষক যে মূল্যে পাইকারের নিকট বিক্রি করে পাইকার সেটি শহরাঞ্চলের আড়ৎদারদের নিকট হস্তান্তরের সময় তার চেয়ে অনেক অধিক মূল্যে বিক্রি করে। আবার আড়ৎদার থেকে শহরের বিভিন্ন অঞ্চলের বিক্রেতারা যখন খুচরা বিক্রয়ের নিমিত্ত খরিদ করে তখন সে মূল্য হতে খুচরা বিক্রয়মূল্য তুলনামূলক বিচারে অনেক বেশি হয়। কৃষক হতে ভোক্তা এর মাঝপর্যায়ে পণ্য হস্তান্তরে বারবার যে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ঘটে এর দ্বারা মধ্যসত্ত্বভোগীরা লাভবান হয়।
বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে সঠিক নীতিমালার অনুপস্থিতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে কৃষক শুধু ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয় না অনেক সময় বাধ্য হয়েই উৎপাদন মূল্যের নিম্নের মূল্যে পাইকারের নিকট পণ্য বিক্রি করতে হয়। কৃষকরা ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হলে অথবা উৎপাদন খরচের নিম্নের মূল্যে পণ্য বিক্রয়ে বাধ্য হলে একটি নির্দিষ্ট সময়অন্তে দেখা যাবে তারা উৎপাদনের প্রতি অনীহা হয়ে অন্য পেশা বেছে নেবে। এভাবে যদি কৃষক অন্য পেশায় চলে যায় তাতে কৃষকের ক্ষতি যতটুকু না হবে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হবে দেশের।
দেশে উৎপাদিত অনেক কৃষিপণ্য বিদেশে রপ্তানি হয়। রপ্তানির মাধ্যমে রপ্তানিকারকরা যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে তাতে বলতে গেলে কৃষকের কোনো লাভ নেই। এমন অনেক কৃষিপণ্য আছে যেগুলো দেশে উৎপন্ন হওয়ার কারণে এ পণ্যগুলো আমাদের আমদানি করতে হয় না। এ সকল পণ্য আমদানি বিকল্প হিসেবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার যে সাশ্রয় করছে এর ভাগিদার কৃষক হলেও তাতেও দেখা যায় কৃষকের কোনো লাভ নেই।
দেশে প্রতিবছরই দেখা যায়, কৃষিপণ্যের ক্রেতা না থাকার কারণে অথবা পাইকারি পর্যায়ে কৃষিপণ্যের বিক্রয়মূল্য উৎপাদন মূল্যের কম হওয়ার কারণে কৃষক পণ্যটি রাস্তায় ঢেলে দিয়ে অভিনবভাবে প্রতিবাদ করছে। কিন্তু তাতে কি হবে, কৃষকের এ ধরনের প্রতিবাদের প্রতি সরকার বা সংশ্লিষ্টদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
কিছু কিছু পণ্য আছে যেগুলো বছরজুড়ে উৎপন্ন হয়। আবার এমন কিছু পণ্য আছে যেগুলো মৌসুমী। বছরজুড়ে উৎপন্ন কৃষিপণ্যের সরবরাহে ঘাটতি না থাকলে বছরের যেকোনো সময় পাইকারি ও খুচরা মূল্যে খুব একটা তারতম্য হয় না। কিন্তু মৌসুমী পণ্যের ক্ষেত্রে মৌসুম বহির্ভূত সময় পণ্যের মূল্যের ব্যাপক তারতম্য ঘটে। এর পিছনে যে কারণ সেটি হলো, পচনশীল পণ্য হলে হিমাগারে রাখতে হয় এবং হিমাগার ভাড়াবাবদ বাড়তি যে খরচ এটিও পরিণামে গিয়ে ভোক্তার ঘাড়ে পড়ে।
বিভিন্ন মৌসুমী পণ্য যেমন আলু, টমেটো, লাউ, ফুলকপি, বাধাকপি, শিম, মুলা, গাজর প্রভৃতি মৌসুমের সময় ব্যাপক উৎপন্ন হয়। এ সময় পণ্যগুলোর মূল্য খুবই কম থাকে কিন্ত মৌসুম বহির্ভূত সময়ে দেখা যায় মূল্য অনেক চড়া। চড়ামূল্যের পিছনে যে কারণ তা হলো মৌসুম বহির্ভূত সময়ে সরবরাহের অপ্রতুলতা এবং হিমাগারের ব্যয়বাবদ বাড়তি খরচ।
কৃষক একটি বিশেষ শ্রেণি। অপরদিকে সকল শ্রেণিপেশার মানুষ সমন্বয়ে ভোক্তা গঠিত। কৃষক দেশটির সৃষ্টিলগ্ন হতেই অর্থনীতিতে অনন্য অবদান রেখে চলেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য তাদের এ অনন্য অবদানের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমাদের কোনো সরকারই তাদের যথার্থভাবে মূল্যায়ন করেনি। আর এ কারণেই কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তন না হয়ে বরং অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে তাদের সক্ষমতা বিনষ্ট হয়েছে। কৃষিপণ্যের প্রাথমিক পর্যায় অর্থাৎ কৃষক যেখান হতে পাইকারের নিকট পণ্য বিক্রয় করে এবং শেষ পর্যায় অর্থাৎ যেখান হতে ভোক্তারা খুচরা বিক্রেতার নিকট হতে পণ্য ক্রয় করে এ দুটি পর্যায়ের মধ্যে যে ব্যাপক ফারাক এর সুবিধা হতে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ে বঞ্চিত। এ বঞ্চনার কারণে কৃষকের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়নি। আর ভোক্তাদের মধ্যে যারা বিশেষত মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত তারা ভোগ্যপণ্য ক্রয়ে অতিরিক্ত মূল্যের কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে তাদের মাসিক খরচ মেটানোর ক্ষেত্রে টানাপোড়নে পড়তে হয়। কৃষিপণ্য বিপণনে মধ্যসত্ত্বভোগীদের অতিরিক্ত মুনাফা ও চাঁদাবাজদের দৌরাত্বে কৃষক ও ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যের যে ব্যাপক ফারাক এটিকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা গেলে একদিকে কৃষকের জন্য ন্যায় মূল্য প্রাপ্তিতে সহায়ক হবে অন্যদিকে ভোক্তা বাড়তি ব্যয় হতে রেহাই পেয়ে এ অর্থ দ্বারা অপরাপর প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে সক্ষম হবে। উভয়ের কল্যাণ ও মঙ্গল সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতি ও জনগণের উন্নয়নের ঈঙ্গিতবহ।
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন