প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে যুক্তিনির্ভর তথ্য পাইনি
রুহিন হোসেন প্রিন্স
প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে যে যৌক্তিক উদাহরণ দেখিয়ে কথা বলেছেন, তার বক্তব্যে প্রথমত আমরা আশ্চর্য হয়েছি ও দেশবাসী হতাশ হয়েছে। কারণ আমরা আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি দিয়েছি, যারা দীর্ঘদিন ধরে দেশের জাতীয় সম্পদ সুন্দরবন রক্ষার জন্য কাজ করছি। আমরা আশা করেছিলাম, প্রধানমন্ত্রী ভাষণের মধ্য দিয়ে যুক্তিপূর্ণ কথা বলবেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেওয়া চিঠিতে বলেছি, অতীতে কোম্পানির দেওয়া যুক্তিগুলো খ-ন করে বলেছিলামÑ কি কি কারণে সুন্দরবন ধ্বংস করবে এই প্রকল্প। আশা করেছিলাম, প্রধানমন্ত্রী কথাবার্তার মধ্য দিয়ে সেই যুক্তিপূর্ণ কথা বলবেন। তিনি সেভাবে কিছু বলেননি। বরং তিনি কোম্পানির পক্ষ থেকে বিজ্ঞাপন দিয়ে যে কথাবার্তা বলা হয়েছে সেই একই কথা বলেছেন। এটি দুঃখজনক একটি ব্যাপার।
অধিক দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, তিনি এই আন্দোলনকে বিএনপির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে অহেতুক কিছু কথাবার্তা বলেছেন। যা আন্দোলনকারী, দেশপ্রেমিক মানুষদের কটাক্ষই করা হয়েছে বলে মনে করি। তিনি যে কথা বলে কটাক্ষ করেছেন, আমরা সেভাবে কটাক্ষ করে জবাব দিতে চাই না, কারণ তিনি এদেশের একজন প্রধানমন্ত্রী। শুধু একথা বলতে চাই, তিনি যে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেছেন, এ যুক্তি ইতোপূর্বেই বাংলাদেশ এবং দেশের বাইরের বিশেষজ্ঞরা খ-ন করেছে।
এমনকি এ সরকার যে একটা পরিবেশগত সমীক্ষা করেছে, সেই সমীক্ষার দিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি তাকান তাহলে দেখতে পাবেন সরকারি তথ্যের সঙ্গে গবেষকদের তথ্য বিভ্রাট আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, উনি বললেন বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাতাস সুন্দরবনের দিকে যাবে না, প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে দেখানো হলো। কিন্তু আমি অনুরোধ করব, এখানে যে পরিবেশগত সমীক্ষা হয়েছে সেই সমীক্ষা দেখলে দেখা যাবে, বছরের নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪ মাস বাতাস সুন্দরবনের দিকেই যায়। বক্তব্যে আরও বলা হয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ছাই ও অন্যান্য বিষয়। পানির বিষয়টা, অনুরোধ করব জাইকা এবং অন্যান্য রিপোর্র্টগুলো যদি উনি দেখেন তাহলে দেখবেন সেখানে যে মাত্রা তার থেকে মিনিমাম ৩-৪০ মাত্রা বেশি হয়েই পানিতে মিশবে। সুতরাং আমরা বলতে চাই, বিষয়টি কারিগরি দিক থেকেও বিবেচনা করলে সুন্দরবনের জন্য এই প্রকল্প ক্ষতি হবে।
আরও আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে যারা বুদ্ধি দেন বা যারা উপদেষ্টা আছেন, তাদের সঙ্গে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটার বেশকিছু পার্থক্য থেকে যাচ্ছে। যেটা মনে রাখতে হবে, সুন্দরবন একটা জলাবন। পৃথিবীতে এরকমের জলাবন দ্বিতীয়টি নেই, যেহেতু পৃথিবীর কোথাও এর দ্বিতীয়টি নেই সেহেতু পৃথিবীর কোথাও সুন্দরবনের মতো স্থানে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে প্রশ্ন অবান্তর।
আরেকটা বিষয় বড়পুকুরিয়া নিয়ে কথা শুনলাম। একটু অনুরোধ করি ২০১৪ সালে রাজশাহীর ইঞ্জিনিয়ার কলেজের একটি বিভাগ মাঠ পর্যায়ে সমীক্ষা করেছে। সেই সমীক্ষার দিকে যদি তাকান, তাহলে দেখবেন সেখানে পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে, সেখান থেকে যে পানি নদীতে যাচ্ছে সেটা অপরিশোধিত, গাছগুলো বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে, জমিতে ফসল যথাযথভাবে হচ্ছে না, মাটি অনেক সময় ডেবে যাচ্ছে। এই সকল সঙ্কটগুলো থেকে যাচ্ছে। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, বড়পুকুরিয়ায় মাত্র ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা থাকলে সেখানে এখন উৎপাদন হয় মাত্র ১২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। আর বড়পুকুরিয়ার থেকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ১০-১২ গুন বেশি। বড়পুকুরিয়ার সঙ্গে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনা দেওয়া একেবারেই অবান্তর।
আমাদের পরিষ্কার কথা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে যুক্তিনির্ভর তথ্য পাইনি যা দিয়ে আমরা আশ্বস্ত হতে পারি, এই প্রকল্প সুন্দরবন ধ্বংস করবে না। ইতোমধ্যে একটা ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করি, ভারতের বিষেশজ্ঞরা বিশেষ করে কলকাতার কল্যাণ দত্ত সহ অনেকেই বলেছেন, সুন্দরবনের কাছে এধরনের প্রকল্প অনুমতি চাইলে ভারত সরকার অনুমতি দিত না। তাছাড়া বিদ্যুৎ খরচ বেশিই পড়বে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই দামের কথাও বলেছেন, সে ব্যাপারেও আমি একটু অনুরোধ করব। সরকারের পক্ষ থেকে যে টেকনোলজির কথা বলা হয়েছে, তাতে খরচও বাড়বে এবং জনগণের ব্যবহারে দাম আরও বেশি পড়বে।
সুন্দরবন ধ্বংসের সকল প্রকল্পের ব্যাপারে আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাব। যতক্ষণ না পর্যন্ত সুন্দরবন ধ্বংসের এসব প্রকল্প বাতিল না হবে।
পরিচিতি : রাজনীতিক
মতামত গ্রহণ : শরিফুল ইসলাম
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন