তিব্বতি যাযাবরদের বদলে যাওয়া জীবন
মোহসীন আব্বাস: চীনের তিব্বত, চারপাশে ছড়ানো ছিটানো অনেকগুলো তাঁবু। এই তাঁবুগুলো পশুপালক তিব্বতিদের। তবে এককালের ইয়ক চড়ানো তিব্বতিদের তাঁবু-গ্রামের মতো প্রশান্ত নয়। একদা এ অঞ্চলে কেবল পর্বত থেকে নেমে আসা শীতল বাতাসের শব্দ শোনা যেতো। এখন এখানে মানুষের জীবন কোলাহলময়। ইন্টারন্যাশনাল নিউইয়র্ক টাইমস
তিব্বতিদের তাঁবু ইয়কের পশম দিয়ে ঢাকা, আছে কাঠের মেঝে। কাঠের উপর কম্বল পাতা। আছে গরম জলে ¯œানের ব্যবস্থা। এমন একটি তাঁবুতে একজন আমেরিকান বারটেন্ডার কাঠের আসবাবের উপর পানীয় তৈরি করছে। এই পানীয়ের নাম মেঘলা যাযাবর ( ক্লআউডি নোমাড)। এই পানীয়টির কাঁচামাল হলো বার্লি ও মধু। এই তাঁবু-রাজ্যে যোগব্যায়ামের ব্যবস্থাও আছে। আর খাবার ঘরের আয়তন বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। পাশে আছে বাষ্প¯œানের আয়োজন।
এটা তিব্বতি উপত্যকার সাধারণ চিত্র নয়, সাধারণ ব্যবসার ধরনও নয়। যাযাবরদের তাঁবু দেখলে, প্রথম দেখায় মনে হবে এক আকর্ষণীয় সামার ক্যাম্প।
চীনা শাসনের তিব্বতে এখনো জীবন বড় কঠিন। ডেচেন ইয়েশি এবং ইদাম কাইয়াত দম্পতি ওই বিলাসবহুল তাঁবুর দোকানটি চালান। তারা বলেন, উচ্চ মূল্যের বাজারে পৌঁছাটা তাদের জন্য কঠিন ছিল। আর সঠিক লোকের কাছে পৌঁছতে পারাটা ছিল আরও কঠিন। এই দম্পতি আরও জানায়, বিলাস কী, এ প্রশ্নটা আমাদের নিজেকেই করতে হয়।
এই বিলাস-তাঁবু নির্মাণ করা হয়েছে সাগরতল থেকে ১০ হাজার ফ্টু উঁচুতে। ওখানেই ইদামদের পিতৃভূমি। এ অঞ্চলকে তিব্বতিরা বলে আমদো। চার পাশে কিছু নেই, উচ্চভূমি, এমন পরিবেশে এ ধরনের তাঁবু নির্মাণ ছিল খুবই কঠিন কাজ। এই তাঁবুর বিভিন্ন অংশ এবং কার্পেট তৈরি করা হয়েছে এ অঞ্চলের প্রধান শহর জিয়াহে-তে। এটা নতুন একটা উচ্চাকাঙ্খি সামাজিক ব্যবসা। ইয়েশি পরিবার প্রথমে তা শুরু করে। এর পরিচালিকা শক্তি হলো মা-মেয়েদের একটি দল।
এই তিব্বতি আমেরিকান পরিবার থাকে গানসু প্রদেশে। তাদের তাঁবু জিয়াহে শহরের বাইরে। কাছেই বিখ্যাত তিব্বতি বৌদ্ধ মন্দির লাবরাং।
এখানে কাপড় তৈরি হয় ইয়কের (পাহাড়ি চমরি গাই) পশম থেকে। বিক্রি হয় নিউইয়র্কে, প্যারিসে বা অন্যকোনো পশ্চিমের শহরে। অনলাইন শপেও বিক্রি হয় আজকাল। এই বিলাসী তাঁবুতে আছে একটি দোকান। দোকানে প্রদর্শিত হচ্ছে নীল শাল, ফিনফিনে উড়না, আর সাদা ক্রসের নকশায় বালিশের কভার।
ইয়েশি পরিবারের যুগসূত্র আছে ভারতের ধর্মশালার সঙ্গে। ডেচেন মজা করে বলে, ওটা তো নিষিদ্ধ দেশ। ডেচেনের বাবা-মা থাকেন ধর্মশালাতে। সেও বেড়ে উঠেছে ওখানেই। ওখানে থাকাকালে তারা তিব্বতে চীনাদের কঠোর নীতির গল্প শুনেছে। নতুন প্রজন্মের সদস্য হিসেবে তারা মূল তিব্বতের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। এরপর তারা এখানে সামাজিক বাণিজ্য উদ্যোগ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।
কিম ইয়েশি, ডেচেনের মা। তিনি এসেছেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। তিব্বতি ধর্মমতের একজন পন্ডিত। তিনি বলেন, তার চিন্তা হচ্ছে, হাতের কাছে যা আছে তা দিয়ে শুরু করা। আর এখানে তিনি তাই করেছেন। কিম ইয়েশি বলেন, এখানে অনেক কিছুই আছে, যা দিয়ে কোনো উদ্যোগ শুরু হতে পারে। চাইলে এখানে যা আছে তা দিয়েই এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-মান বদলানো যায়, তাদের সংস্কৃতিকে রক্ষা করা যায়।
কিম ইয়েশির স্বামী কালসাঙ। তাদের পরিচয় হয় যখন তারা ভাষার কলেজে পড়তেন। এরপর এই যুগল শ্যারলটভিলে চলে যায়। ওখানে ইয়েশি ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিব্বতি বৌদ্ধ-মতের উপর উচ্চতর ডিগ্রি নেন। এর পর তিনি ধর্মশালায় যান এবং লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকেন।
ওখানে ইয়েশি বয়ন শিল্পের দিকে ঝুঁকে পড়েন। তার ধারণা জন্মায় বস্ত্র একটা নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে, আর পারে কর্মের সন্ধান দিতে। এ নিয়ে তিনি তিব্বতি উদ্বাস্তুদের মধ্যে কাজ শুরু করেন। তিনি ঐতিহ্যগত হস্তশিল্প নিয়ে কাজ শুরু করেন। তার খেয়াল চাপে ইয়কের পশম থেকে কাপড় তৈরি করবেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি ডেচেনের সঙ্গে আলোচনা করেন।
২০০৪ সালে ডেচেন আমদো এলাকায় আসেন একটি ফিল্ম তৈরির লক্ষ্য নিয়ে। এর পর ইয়েশি তার ভাইয়ের সঙ্গে সাত মাস কাটান গ্রামের বাড়িতে। তার মায়ের অনুরোধে দুই টন পশম জোগাড় করেন তিনি। নেপালে নিয়ে গিয়ে এই পশম থেকে সূতা তৈরি করা হয়। ২০০৬ সালে তাদের গ্রামেই তার মেয়ের জন্য ছোট একটি কারখানা গড়ে দেন ইয়েশি। আর এটাই এই পরিবারের তিব্বত জীবনের যাত্রা শুরু।
তিব্বতি গ্রামের জীবন সংগ্রাম বড় কঠিন। এক লোকালয় থেকে আরেক লোকালয়ে যেতে হয় ঘোড়ায় করে। সময় লাগে দু’তিন দিন। ইয়েশি স্মৃতিচারণ করেন। বলেন, তখন জুলাই মাস। হঠাৎ কিছু ঘেসো জমিকে ন্যাড়া দেখা গেলো। তিনি বুঝতে পারলেন পশুর চেয়ে তৃণভূমি কম। তাই যাযাবরদের কর্মসংস্থানের দরকার। আর তারা তখন ঐতিহ্যবাহী পশুপালন পদ্ধতিও অনুসরণ করছিলেন। চীনা কর্তৃপক্ষ এমন বাড়তি পশু পালনের জন্য যাযাবরদের উৎসাহিত করছিল। কারণ এর ফলে কর্তৃপক্ষ তাদের অন্য গ্রামে নিয়ে যেতে পারে যুক্তিসঙ্গত ভাবে।
এদিকে, যাযাবরদের জীবনেও লেগেছে পরিবর্তনের হ্ওায়া। তরুণ প্রজন্ম আর যাযাবর থাকতে চাইছে না। স্কুলে যাওয়া তরুণরা যাযাবরের জীবন, বিশেষ করে নারীদের যাপিত জীবকে আর মানতে পারছে না। কারণ অর্থনীতির রঙের সঙ্গেই তো জীবনের রঙ বদলায়।
ইতোমধ্যেই বয়ন শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য জমি পাওয়া গেছে, জরজে রিতোমা গ্রামে। এখানে দু’শ যাযাবর পরিবারের বাস। ইয়েশি তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য নিয়ে যায় কম্বোডিয়া ও নেপালে। পশমের বয়নশিল্প বদলে দেয় যাযাবরদের জীবন। পরিবারগুলোকে আর বিচ্ছিন্ন হতে হয়নি। কোনো শহরে গিয়ে কাজের সন্ধান করতে হয়নি তাদের। এই কর্মযজ্ঞের পাশেই এখন ভালো তাঁবু, ভালো খাবার এবং বিলাসী জীবনের হাতছানি। সম্পাদনা : রাশিদ রিয়াজ