স্বাধীনতার প্রকৃত তাৎপর্য নষ্ট হয়েছে
যতীন সরকার
পরিচিতি : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
গণতন্ত্র যেন এখন আমাদের কাছে ভোট, ভোটের অধিকার, ভোট দেওয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। যখন প্রকৃত প্রস্তাবে ভোটের অধিকার চলে গিয়েছিল, তখন ভোটের অধিকার প্রাপ্তির জন্য আমরা আন্দোলন করেছি। আন্দোলন করেই নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকে ভোটের অধিকার লাভ করেছি। কিন্তু অধিকার লাভ করার পরও দেখলাম ভোটের অধিকার আসলে প্রকৃত প্রস্তাবে কোনো কাজে লাগে না। তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলন করে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলাম। ভোটের অধিকার যদিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, প্রকৃত প্রস্তাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিনা সেই বিষয়ে ভাববার অবকাশ রয়েছে। আমাদের সংবিধানে স্পষ্টভাবে লেখা রয়েছে, এই রাষ্ট্রের মালিক হচ্ছে জনগণ। এখন জনগণ যদি তার সেই মালিকানা বুঝে না নেয় এবং যদি মনে করেন, আমরা যাদের প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছি, তারাই আমাদের জন্য সবকিছু করবে তাহলে প্রকৃত গণতন্ত্র কোনোদিনই প্রতিষ্ঠিত হবে না। যাকে আমি প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছি, সেই জনপ্রতিনিধিরা ক্ষমতায় গিয়ে প্রতিনিধিত্বের মর্যাদার রক্ষা করে কিনা সেই বিষয়ে যদি সর্বদা সতর্ক, সচেতন থাকতাম তাহলে গণতন্ত্রের আরও বেশি ফল আমরা পেতে পারতাম। কিন্তু আমরা সেই সচেতনতা দেখাইনি, সেটাই বাস্তব সত্য।
সার্বভৌমত্ব কখনও প্রতিনিধিত্বের বিষয় হতে পারে না। কিন্তু আমরা আমাদের সার্বভৌমত্ব প্রতিনিধিদের দ্বারাই সংস্থাপিত হবে, কিন্তু তা যে হয় না এ বিষয়ে সচেতনতা কম। সচেতন হলে দেখতে পেতাম, প্রতিনিয়তই আমরা প্রতারিত হই আমাদের প্রতিনিধিদেরই হাতে। আজ দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এই টাকা পাচার কিÑ আমি, আপনি, গ্রামের সাধারণ মানুষ করে? নিশ্চয়ই না। কিন্তু আমার-আপনার ট্যাক্সের টাকায় বিদেশে আলিশান বাড়িঘর উঠছে একেকজনের। এসব ঘটনাবলি ঘটাচ্ছে যারা তাদের সম্পর্কে যদি আমরা সচেতন না হই, সচেতন হয়ে গণআন্দোলন যদি না করি তাহলে প্রকৃত প্রস্তাবে সত্যিকারের গণতন্ত্র কখনও প্রতিষ্ঠিত হবে না। যখন এরকম শুনি, উন্নয়ন ও গণতন্ত্র দুটিকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে উন্নয়ন দরকার, গণতন্ত্র নয়। যখন এসব কথাবার্তা যারা বলেন তাদের ঘৃণা প্রকাশের কোনো ভাষা আমার জানা নেই।
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় সুফল পাওয়ার কথা গণতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই আমরা চার মূলনীতি করেছিলাম। গণতন্ত্রের জন্যই এসব প্রয়োজন। সমাজতন্ত্র তো আমরা কবরই দিয়েছি। এখন আমরা বাজার অর্থনীতির পাল্লায় পড়েছি। তার ফলেই স্বাধীনতার প্রকৃত তাৎপর্য নষ্ট হয়েছে। স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল জনগণের কাছে পৌঁছায় না, পৌঁছাবেও না।
তরুণদের মধ্যেই আমার ভরসা। সংকট, সমস্যার মধ্যেও তাদের প্রতি আমার অনেক আস্থা রয়েছে। আশাবাদী। গণজাগরণ মঞ্চ যখন গড়ে উঠতে দেখেছিলাম, তখন আমি আশাবাদী ও উদ্দীপ্ত হই। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক, যাদের দ্বারাই হোকÑ গণজাগরণ মঞ্চটাকে নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। আর গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে যারা যুক্ত রয়েছে, তারা আরও সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য যেভাবে, সেসব বিষয় নিয়ে গণআন্দোলন করা উচিত, তা তারা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তারপরও তাদের মধ্যেই আমি একটা সম্ভাবনা দেখছিÑ তরুণেরা অনেকের চেয়ে একটু অন্যরকমভাবে ভাবে। তরুণেরা তথাকথিত গণতন্ত্র, দেশে যা চলছে, তার সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে নেয় না। আমার যদি কোনো ভরসা থাকে কারও ওপর, তা তরুণ সমাজের ওপরই। কিন্তু সেই তরুণ সমাজকে নষ্ট করছে কারা? আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। এসবের বিরুদ্ধে খুব ক্ষীণ হলেও তরুণ সমাজের মধ্যে একটা নতুন চিন্তাভাবনার জাগরণ দেখা দিচ্ছে, ভরসা সেই জায়গাতেই। তরুণদের মধ্যে নতুন চিন্তার জাগরণ ঘটছে, আমার ভরসা সেখানেই।
সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে মতামতটি লিখেছেন আশিক রহমান
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন