উত্তাল সেই দিনগুলো
ড. কামাল হোসেন
লেখক : সংবিধান প্রণেতা ও রাজনীতিবিদ
ভুট্টোর সঙ্গে ব্যর্থ আলোচনা এবং জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানে বিলম্বের ফলে শঙ্কা ঘনীভূত হয়ে উঠতে লাগল যে ইয়াহিয়া ও সামরিক জান্তা জাতীয় পরিষদ বসতে না দেওয়ার জন্য ছুতো খুঁজছে।
ভারতের ওপর দিয়ে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সৈন্য চলাচল ও পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত সৈন্যদের জন্য অস্ত্র ও রসদ সরবরাহ বিঘিœত হয়ে পড়েছিল, যা তাদের সামর্থ্য ও কর্মক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করল।
১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারির গোড়ার দিকে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার সম্ভাব্যতা নিয়ে সক্রিয়ভাবে আলোচনা করেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানে বিলম্ব আওয়ামী লীগকে তার নিজস্ব বিকল্পগুলো বিবেচনায় অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রণোদিত করে। একটি স্বাধীনতার ঘোষণা করে রাখার সিদ্ধান্ত হলো। ওই ঘোষণা দেওয়া হলে তার বিরুদ্ধে সামরিক আঘাত কতটা জোরালোভাবে আসতে পারে এবং সেক্ষেত্রে ওই আক্রমণ মোকাবিলা করে বিজয়ী হওয়ার জন্য জনগণের শক্তি কতটুকুÑ সবকিছুই সতর্কভাবে বিবেচনার প্রয়োজন ছিল। বিদ্যমান সামরিক শক্তি সম্পর্কে কিছুটা হিসাব করে দেখা হলো। ভারতের ওপর দিয়ে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং এর ফলে সৈন্য ও রসদ সরবরাহে সৃষ্ট অসুবিধার বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হলো।
আমাকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে একটি খসড়া তৈরি করতে বলা হলো। এই খসড়া তৈরিতে নমুনা হিসেবে ব্যবহৃত হলো মার্কিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ভাষ্য, যেখানে ওই ঘোষণাকে যুক্তিসংগত করতে ব্রিটিশ শাসনের অন্যায়-অবিচারকে তুলে ধরা হয়েছে। খসড়াটি প্রস্তুত হলে ১০ ফেব্রুয়ারি আমি সেটি শেখ মুজিবের হাতে তুলে দিলাম এবং তিনি সেটি নিজের কাছে রাখলেন। তাজউদ্দীন আহমদ ওই খসড়া প্রণয়নের কাজে যুক্ত ছিলেন। যদি স্বাধীনতা ঘোষণার কর্মপন্থা গৃহীত হয়, সেক্ষেত্রে ওই ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনার রূপরেখা প্রণয়ের দায়িত্বও ছিল তাজউদ্দীন আহমদেরই। ওই পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো ছিলÑ রাজপথে লাখ লাখ মানুষ নামিয়ে দিয়ে প্রধান প্রধান শহরে ব্যাপক গণবিক্ষোভ শুরু; এভাবে সামরিক বাহিনীকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় ফেলে বেতারকেন্দ্রে, সচিবলায় ও গভর্নরস হাউজ দখল এবং নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। গভর্নরের কাছ থেকে ঘোষণা আদায় ইত্যাদি।
ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদ আহ্বানের জন্য চাপ অব্যহত রাখে। ‘ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য’ ১৩ ফেব্রুয়ারি জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সব আওয়ামী লীগ সদস্য ও দলের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের এক যৌথসভা আহ্বান করা হয়। ব্যাপকভাবে ধারণা করা হতে থাকে, স্বাধীনতা ঘোষণা সিদ্ধান্ত বিবেচনার উদ্দেশ্যেই ১৩ ফেব্রুয়ারির ওই সভা আহ্বান করা হয়েছে। আমার মনে পড়ে, সভার প্রাক্কালে বিদেশে কুটনীতিক শেখ মুজিবকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এই বৈঠকে কি আপনারা এক তরফা স্বাধীনতার ঘোষণা (টহরষধঃবৎধষ উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ওহফবঢ়বহফবহপব) দিতে যাচ্ছেন?’
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান বিলম্বের কারণে পরিস্থিতি ইতোমধ্যেই বিস্ফোরণোম্মুখ হয়ে উঠেছিল। এমতাবস্থায় আওয়ামী লীগের ওই যৌথসভা অনুষ্ঠানের দিন সকালে ইয়াহিয়া ঘোষণা করলেন, ৩ মার্চ ১৯৭১ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বসবে।
ইয়াহিয়া ঘোষণায় ভুট্টোর প্রতিক্রিয়া ছিল সংকটের দিকে আরেক পা এগিয়ে যাওয়া। ১৫ ফেব্রুয়ারি পেশোয়ারে এক বিবৃতিতে ভুট্টো ছয় দফা প্রশ্নে ‘আপস বা সমঝোতার লক্ষ্যে কোনো মতৈক্যের অনুপস্থিতিতে ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের বৈঠকে যোগদানে তার দলের অসামর্থ্য প্রকাশ করলেন। ভুট্টো আরও বললেন, যে ঢাকায় গেলে তার দলের সদস্যরা বিপদে পড়বেন এবং ভারতীয় বৈরিতা ও ছয় দফা মেনে না নেওয়ার কারণে ‘দুই দফা জিম্মি হওয়ার অবস্থানে’ তিনি নিজেকে নিয়ে যেতে পারেন না। ১৬ ফেব্রুয়ারি করাচিতে ভুট্টো বললেন, আসন্ন জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে তার দলের যোগদান না করার সিদ্ধান্ত অটল ও অপরিবর্তনীয়।
১৭ ফেব্রুয়ারি করাচিতে ভুট্টো বললেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে আসন্ন জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে পিপলস পার্টির অংশগ্রহণ অর্থহীন।’ ভুট্টো বললেন, তার দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমঝোতামূলক বন্দোবস্ত ও মতৈক্যে পৌঁছাতে যথাসাধ্য করেছে। কিন্তু এখন ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে আর আলোচনার কোনো অবকাশ নেই।’ আওয়ামী লীগের ছয় দফা প্রসঙ্গে ভুট্টো বললেন, ‘সবচেয়ে মুশকিল হলো বৈদেশিক বাণিজ্য বৈদেশিক সাহায্যসংক্রান্ত দফাটি নিয়ে।’
ভুট্টোর এসব কথাবার্তায় পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হলো যে, তিনি অবস্থান কঠোর করেছেন এবং তা জানুয়ারি শেষ নাগাদ। ঢাকায় দেওয়া তার বিবৃতির পরিপন্থি। জানুয়ারিতে ভুট্টো বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আরও আলোচনা চালানো হবে এবং এধরনের আলোচনা এমনকি জাতীয় পরিষদের ভিতরেও চলতে পারে। পক্ষান্তরে ভুট্টো এখন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে অংশ নিতেই অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন এবং জেদ ধরে বসেছেন যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আর কোনো আলোচনার অবকাশ নেই।
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন