নতুন ধারার রাজনীতির উদ্বোধন ঘটুক
হায়দার আকবর খান রনো
বাংলাদেশে গণতন্ত্র কোনোদিনই ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম মূলভিত্তি গণতন্ত্র কোনোদিনই অর্থবহ হয়ে ওঠেনি। সাড়ে চার দশকে অনেক রকম সাংবিধানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। নানা ধরনের শাসন ব্যবস্থার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমরা গেছি। পার্লামেন্টারি শাসন, প্রেসিডেনশিয়াল শাসন, একদলীয় শাসন ব্যবস্থা, সামরিক শাসন, বেসামরিক লেবাসে সামরিক শাসন, তত্তাবধায়ক সরকারের নামে অদ্ভূত ধরনের সরকারÑ সবকিছু দেখা আছে। শুধু দেখা হয়নি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। এর কারণও আছে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলেও ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল এমন এক উঠতি বুর্জোয়া শ্রেণি, যারা ছিল উৎপাদন বিমুখ এবং রাষ্ট্রীয় ও জনগণের সম্পত্তি লুণ্ঠন করেই যারা সম্পদের স্ফীতি ঘটিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনেক স্বপ্ন থাকলেও তা বাস্তবায়িত হতে দেয়নি তার চারপাশের লোকজন, যাদের সম্পর্কে তিনি নিজেই বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন একাধিকবার। এই শ্রেণি বেপরোয়া লুটপাট, বৈদেশিক ঋণের বেশিরভাগ আত্মসাৎ, রাষ্ট্রীয় কলকারখানা ব্যাংক ইত্যাদি পানির দামে ক্রয় করে সম্পদ বাড়িয়েছিল। পরবর্তীতে তাদের একটা অংশ শিল্পে বিনিয়োগ করলেও প্রধানত গার্মেন্টস খাতে (যা আসলে দর্জির কারখানা, মূল শিল্প নয়), তাদের মুৎসুদ্দি ও লুটেরা চরিত্র অব্যাহত থেকে গেছে। গণতন্ত্র এই শ্রেণির জন্য বিলাসিতা মাত্র। শিল্পের ক্ষেত্রেও দেখি তারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে কম মজুরি দেয়, ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেয় না। গণতন্ত্র বলতে কেবল নির্বাচন বোঝায় না। শ্রম আইন, নিম্নতম মজুরি, মানুষের জীবনের চাহিদা পূরণÑ গণতন্ত্রের আধুনিক সংজ্ঞার মধ্যে এসব পড়ে। যতদিন লুটেরা ধনিক শ্রেণি রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকবে ততদিন ন্যূনতম গণতন্ত্রও আশা করা যায় না। গণতন্ত্রকে যদি খুবই সংকীর্ণ অর্থে ধরি, এমনকি যদি বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ন্যূনতম উপাদানের সন্ধান করি তাহলেও দেখব গণতন্ত্র অনুপস্থিত। বর্তমানে দুই দিক থেকে গণতন্ত্র আক্রান্ত হচ্ছে।
একদিকে কর্তৃত্ববাদী শাসন অপরদিকে ধর্মের নামে মৌলবাদী সন্ত্রাস। বর্তমান আমলে গণতন্ত্রের একেবারে প্রাথমিক শর্ত যে নির্বাচন, সেটাই প্রহসনে পরিণত হয়েছে। ২০১৪ সালে অর্ধেকের বেশি আসনে কোনো ভোটই হয়নি। বাকি আসন সমূহেও কার্যত কোনো ভোট হয়নি। তবু সংবিধান অনুসারে সেটা নির্বাচন ছিল। কিন্তু এরপর ঢাকা, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা এর সবশেষে ইউপি নির্বাচনে যা দেখলাম তাতে আর যাই হোক, নির্বাচন বলে কিছু থাকল না। পুলিশ ও প্রিজাইডিং অফিসার দিয়ে সিল মারা, আগের রাতে সিল মারা ইত্যাদি যে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা করল তার পরিণতি বড় ভয়াবহ। উপরন্তু ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যা গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছে।
ক্রসফায়ার ও বিচার বহির্ভূত হত্যা শুরু করেছিল বিএনপি সরকার ক্লিনহার্ট অপারেশন নামে। আরও যে বড় অপরাধ করেছিল খালেদা জিয়া তা হলোÑ ক্লিনহার্ট অপারেশনে যারা হত্যা বা নির্যাতন করেছিল পার্লামেন্টে আইন করে, তাদের দায়মুক্তি দিয়েছিলেন। তাই আজ যখন বেগম জিয়া ও বিএনপি গণতন্ত্রের কথা বলেন, তখন তাতে সাড়া মেলে না। উপরন্তু বিএনপি জোট বেধেছে জামায়াতের সঙ্গে। এই কারণে ধর্মীয় জঙ্গিবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্যের ডাকেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। বস্তুত গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এই দুই বড় দলের বাইরে বাম ও উদারপন্থি দল ও ব্যক্তির সমাবেশ ঘটাতে হবে। জনগণই সংগ্রামের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে অর্জন করবে। নতুন ধারার রাজনীতির উদ্বোধন ঘটুক।
লেখক : প্রসিডিয়াম সদস্য, সিপিবি
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন