সংঘাতের রাজনীতির মূল উৎস কোথায়?
মোহাম্মদ এ আরাফাত
বিভিন্ন আলোচনায়, বক্তব্যে, কথায় কথায় দেশের বিদ্বেষ ও সংঘাতপূর্ণ রাজনীতির প্রসঙ্গ আমরা তুলি। বলি, এই সংঘাতের রাজনীতি অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা এগিয়ে যাওয়ার পথে একটি প্রধান অন্তরায়। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, রাজনীতিতে যে সংঘাতের সংস্কৃতি বিদ্যমান, তা উন্নয়ন সম্ভাবনাকে প্রতিনিয়তই সংকুচিত করছে। কিন্তু এই সংঘাতের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার কোনো উপায় নেই? সুশীল সমাজের বিভিন্ন জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় শুধুমাত্র সমস্যা নিয়ে আলোচনা শুনি, কোনো সমাধানের পথ কেউ দেয় না। যেন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করলেই সমাধানের পথ বেরিয়ে আসবে।
সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে গেলে সমস্যা তৈরির মূল উৎসও খুঁজে পেতে হবে এবং এই মূল উৎসেই আঘাত করতে হবে। কিন্তু কেউ যেন সমস্যার মূলে যেতে চান না, মূলে আঘাত করা তো দূরের কথা।
আজকে বাংলাদেশের এই সংঘাত কিংবা বিদ্বেষের রাজনীতির মূলে তা কি আমরা কখনও ভেবে দেখেছি? একটি দেশ বা সমাজ যে মৌলিক স্তম্ভের ওপর দাঁড়ায়, যেখানে দলমত নির্বিশেষে ঐক্যমত থাকতে হয়, বাংলাদেশ সেখানে বিভাজিত। সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্র বাংলাদেশ, যেখানে জাতীয়তাবাদ দুটি! একটি বাঙালি, অপরটি বাংলাদেশি। শুধুমাত্র জাতীয়তাবাদ নয়, জাতীয় সেøাগানও দুটিÑ ‘জয় বাংলা’ ও ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’! এই রাষ্ট্রের জšে§র ইতিহাসও দুটিÑ ‘সঠিক ইতিহাস’ ও ‘বিকৃত ইতিহাস’। সংবিধানও দুটিÑ একটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ, অসাম্প্রদায়িক সমাজ, সুষম বণ্টনভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, অপরটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল সংবিধান।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মতপার্থক্য থাকবে, কিন্তু মৌলিক বিষয়গুলোতে বিভাজন পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনো দেশে নেই, যা বাংলাদেশে রয়েছে। ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা যেসব বিষয়ে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা করেছিলাম লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে, তা কেন আজ বিভাজিত? কারা প্রতিষ্ঠা করল জয় বাংলার বিপক্ষে ‘জিন্দাবাদ’? কারা অসাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীলতাকে আমদানি করল এই স্বাধীন বাংলাদেশে?
বাংলাদেশের বিদ্বেষ ও সংঘাতপূর্ণ রাজনীতির মূলে রয়েছে এই বিভাজন। এই বিভাজন দূর করতে না পারলে বিদ্বেষ ও সংঘাত দূরভিত হবে না। দলমত নির্বিশেষে এই বিভাজনের মূলে আঘাত করতে হবে। জাতিকে তথা নতুন প্রজš§কে উদ্বুদ্ধ করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। কাজটি সহজ হবে না। নতুন প্রজšে§র একাংশকে দীর্ঘ সময় ধরে করা হয়েছে প্রচ- কলুষিত ও দূষিত। তরুণ প্রজš§কে কলুষমুক্ত করতে হবে ধাপে ধাপে, পর্যায়ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হবে ঐক্যমত। দূর হবে সংঘাতের রাজনীতি, প্রত্যাশিত উন্নয়ন, উন্নতির দিকে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
লেখক : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক / সম্পাদনা : জব্বার হোসেন