মুক্তচিন্তা কতটা মুক্ত! সুলতানা কামাল
পরিচিতি মানবাধিকারকর্মী
একাত্তরে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। যে স্বাধীনতা আমরা চেয়েছিলাম, তা অর্জিত হয়েছে। পেয়েছি একটি স্বাধীন ভূখ-। ভূখ-ের দিক থেকে স্বাধীনতা পেলাম, সামনের দিকে এগোনোর জন্য আমরা প্রস্তুতিও নিতে থাকলাম। কিন্তু পঁচাত্তরে এমনই এক অঘটন ঘটল এবং তার ফলে যে আঘাত এলো আমাদের ওপর, বাংলাদেশের যে মৌলিক চেতনা তৈরি হয়েছিল বহুদিন ধরে, পঁচাত্তরের পর তা একেবারে পিছনের দিকে ঠেলে দেওয়া হলো। এখন প্রশ্ন উঠছে, যে চেতনায় আমরা বিশ্বাসী, যে চেতনার ওপর ভর করে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, সেটি আমরা আর কি পরিপূর্ণভাবে ফিরে পাব? আমার বিশ্বাস আছে পাওয়ার। আমার আস্থা রয়েছে মানুষের ওপর। গোটা সমাজের ওপর। যে সমাজের মানুষেরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করে, ভাষা আন্দোলন করে, একাত্তরে অকাতরে রক্ত দিতে পারে সে সমাজ বিনষ্ট হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিলুপ্ত হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এখনো মানুষ ভালোভাবেই ধারণ করে বলেই আমার বিশ্বাস। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে রক্ষা করার জন্যই তো গণতন্ত্র, মানবাধিকার সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব। তা যদি আমরা শক্ত হাতে সংরক্ষণ করতে না পারি, সেটার প্রতি দৃঢ় সমর্থন যোগাতে না পারি, এ দেশের সংকট শেষ হবে না। বারবার প্রগতিশীলতার ওপর, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর আঘাত আসবেই।
রাজনীতিবিদেরা অনেক কৌশল নেন। আপসকামিতার পথেও হাঁটেন। তবে কৌশল ও আপসকামিতার মধ্যে তফাত রয়েছে। বাস্তবতার কারণেও অনেক সময় কৌশলী হতে হয়। এখন আমরা যা দেখি তা হলোÑ আপসকামিতা। কিসের জন্য? ক্ষমতার জন্য। আধিপত্য বজায় রাখার জন্য। এই জিনিসটি ঢুকে গেছে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে, যা একটি প্রগতিশীল রাষ্ট্র গঠনের পথে বাধা হিসাবেই কাজ করবে। সেটা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত নয়। ধর্ম চর্চা নিয়ে নানা কথা রয়েছে সমাজে। নানা ভাবনা রয়েছে মানুষের মধ্যে। রাজনীতিবিদেরা মনে করেন, আমি যত বেশি ধর্মানুরাগী হিসাবে নিজেকে উপস্থাপন করব, তত বেশি মানুষের সমর্থন পাব। রাজনীতিবিদেরা যতক্ষণ ধর্মমিশ্রিত ক্ষমতার রাজনীতির চর্চা করবেন, ততদিন তারা এই নিয়ম থেকে বের হতে পারবেন না। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি চলতে দিলে এ পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না। কিন্তু লাখো মানুষের রক্তে অর্জিত এই দেশে এমনটি হতে পারে না। কারণ আমাদের মূল কথাই ছিল জাতি, ধর্ম, শ্রেণী, লিঙ্গ, কে কোথায় জন্মগ্রহণ করেছে নির্বিশেষে সমান অধিকার ও সমান মর্যাদার দাবীদার হবে। রাষ্ট্র কোন কারণেই কারো প্রতি বৈষম্য প্রদর্শণ করবে না।
ব্লগ লিখেন কোনো একজন মানুষ। লেখক সেই মানুষটিকে যখন হত্যা করা হয়, তখন সেই মানুষটি মানুষ না হয়ে, হয়ে যান ব্লগার! আমাদের দায়িত্বশীল গণমাধ্যমই এই কাজটি করে আসছে, রাজীব হায়দার হত্যাকা-ের পর থেকেই। আমাদের দায়িত্বশীল গণমাধ্যমেÑ একজন রক্ত মাংসের মানুষকে জনগণের সামনে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় ব্লগার হিসাবে! প্রগতিশীল, দায়িত্বশীল, মুক্তচিন্তার গণমাধ্যম কীভাবে এই কাজটি করে?
অভিজিৎ একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। বিজ্ঞান নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। তার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। সেই অভিজিৎকে, মানুষ অভিজিৎ পরিচয় না দিয়ে, আমাদের গণমাধ্যম তাকে জনগণের সামনে ব্লগার হিসেবে তুলে ধরেছে! যেন ব্লগার একটি বিশেষ ক্যাটাগরি! এটি কী ধরণের দায়িত্বজ্ঞান? আর যদি রাজীব হায়দার, অভিজিৎ কিংবা ওয়াশিকুরÑ যারা ধর্ম নিরপেক্ষতা বা বিজ্ঞান-এর চর্চার কথা লেখে তাদের ব্লগার হিসাবে অভিহিত করা হবে, তাহলে যারা ওই একই ব্লগে ধর্ম প্রবক্তার ভূমিকা নেয় তারা ব্লগার নয় কেন? ব্লগার এর সঙ্গে নাস্তিকতাকে সমার্থক বলে দেখানোর কি যুক্তি থাকতে পারে? এবং তাকে হত্যাই বা করা হবে কেন?
কোনো যুক্তিতেই, কোনোভাবেই হত্যাকা- বৈধতা পেতে পারে না। কারণ হত্যাকা- হচ্ছেÑ ফৌজদারি অপরাধ। দেশের আইন অনুযায়ী, যিনি হত্যা করেন তাকে শাস্তি পেতে হয়। কোনো একজন ব্যক্তির যেকোনো কথা, বক্তব্য কারও কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে, কারও কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারেÑ কোনো একটি মত, কারও একটি বক্তব্য পছন্দ হবে না বলে কাউকে হত্যা করতে হবে, এটা কী ধরনের কথা? একটা সমাজে বহু মানুষ থাকে, তাদের চিন্তা চেতনাও বহুরকম হয়। এটা খুবই স্বাভাবিক। সেটার সঙ্গে তো হত্যাকা-ের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। দৃশ্যমান হত্যাকা-গুলোর বাইরেও হয়তো আরও ঘটনা ঘটছে, যা আমরা জানি না। এসব বন্ধ করতে হবে। এটা স্পষ্ট যে, মানুষকে আতঙ্কিত করে উদ্দেশ্য হাসিলের কৌশল নিয়েছে জঙ্গিবাদীরা। খুব কম সময়ের মধ্যে, পরপর ঘটে যাওয়া হত্যাকা-গুলো মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। তবে খুব সম্প্রতি সরকারের তৎপরতা কিছুটা আশার আলো ছড়িয়েছে একথাও স্বীকার করতে হয়।
সমাজ তো কোনো খ- খ- জনগোষ্ঠী নয়, সবটা মিলিয়েই এই সমাজ। সমাজের সকল স্তরে উগ্র মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের সমর্থক, বিশেষত ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। অপরাধের প্রতিকার দেওয়ার দায়িত্বে যারা থাকেনÑ পুলিশ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে তারা অধিষ্ঠিত।
একটা অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়তে হলে, সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এটা সম্ভবও। এ দেশের অধিকাংশ মানুষই প্রগতিশীল, মুক্তমতে বিশ্বাস করে, অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাস করে। সুযোগ পেলে তারা এগিয়ে আসবে। এগিয়ে তারা সব সময় এসেছে। ১৩ সালে ৫ ফেব্রুয়ারিতে গণজাগরণ ঘটিয়ে এ দেশের মানুষ তার প্রমাণ আরও একবার রেখেছে। প্রয়োজনে আবারও তারা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। তবে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে রাষ্ট্রকে। সরকারকে। গণমাধ্যমকেও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। মানুষের হয়ে কাজ করতে হবে।
আমরা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির কথা বলি। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি মানে তো কোনো বায়বীয় ব্যাপার নয়। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি মানেÑ তাদের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা মানতে হবে। সম্প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সবকিছু দেখতে হবে। নিজেকে যদি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি বলি, তাহলে আমাকে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধগুলোর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে। আমি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির কথা বলছি, কিন্তু আমি আনুগত্য প্রকাশ করছি না, বরং বিপরীত ধর্মী কর্মকা-ের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন করছিÑ সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি হিসেবে নিজেকে দাবি করলে, আমাকে তা প্রমাণ করতে হবে। দৃশ্যমান করতে হবে। কার্যকর পদক্ষেপ ছাড়া এ সমস্ত কথা মানুষ বিশ্বাস করবে না।
মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের জন্য, গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের স্বার্থে সকল নাগরিকের সমান অধিকার ও সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠার স্বার্থেÑ সংকীর্ণ জঙ্গিবাদ-মৌলবাদমুক্ত সমাজ গঠনই হবে মুক্তমত, মুক্তপথ।
সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে মতামতটি লিখেছেন আশিক রহমান
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন