আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্র চলছে
শাহরিয়ার কবির, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশিক রহমান
গণহত্যাকারীদের বিচার বানচাল করার জন্য জামায়াত ও তার সহযোগিদের চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র চলছে। তার সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করেছি, প্রশাসনেরও কেউ কেউ যুক্ত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমরা অনুরোধ করব, খুব কঠোরভাবে প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অবস্থানকারী জামায়াত ও গণহত্যাকারীদের সমর্থকদের সেখান সরিয়ে দেওয়ার। ৩০ লাখ শহীদের প্রতি আমাদের যে অঙ্গিকার, সেই অঙ্গিকার পূরণ করতে হবেÑ আমাদের অর্থনীতিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেন ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্র চলছে। সেকারণেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ এখন খুব জরুরি। শেখ হাসিনারা কারণেই আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। তার জন্যই পুরোনো হাইকোর্ট ভবনে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যাবতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধকতা, প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে যুদ্ধাপরাধ বিচারটি সামনে এগিয়ে গেছেন। এমনকি জাতিসংঘ মহাসচিব, আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির টেলিফোনকে অগ্রাহ্য করেছেন। পাকিস্তান, তুরুস্ক সরকারের যাবতীয় চাপ অগ্রাহ্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বিচারকাজ অব্যাহত রেখেছেন। ইতোমধ্যেই অনেকেরই দন্ড কার্যকর করা হয়েছে। এখনো আমাদের শেষ ভরসা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই। আমরা তাকেই অনুরোধ জানাব, আপনার শাসনকারের শ্রেষ্ঠতম অর্জন হচ্ছে, এই বিচার। যা পৃথিবীর ইতিহাসে উল্লেখিত হবে, আপনি চল্লিশ বছর পর এই গণহত্যাকারীদের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বিচারটি যথাযথভাবে শেষ করেছিলেন। সারা পৃথিবী তাকিয়ে আছে, এই বিচারের দিকে। বিশেষ করে সেই সব দেশ, সেই সব জাতি যারা গত শতাব্দীতে গণহত্যার শিকার হয়েছিল ও যারা গণহত্যার বিচার করতে পারেনি। কারণ সাধারণভাবে বলা হয়, এই বিচার অত্যন্ত ব্যয়বহুল। জাতিসংঘের সহযোগিতা লাগবে। অনেক আয়োজন করতে হয় এসব বিচারের ক্ষেত্রে।
তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনা স্থাপন নিয়ে ২০০৯ সালের ১০ ডিসেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমরা একটি চিঠি দিয়ে বলেছিলাম, কেন আমরা পুরোনো হাইকোর্ট ভবনকে এই বিচারের জন্য উপযুক্ত মনে করি। প্রধানমন্ত্রী আমাদের অনুরোধ শুনেছেন, রক্ষা করেছেন। তার নির্দেশেই ওই ভবনে ট্রাইব্যুনাল স্থাপিত হয়েছে। এখানে অনেক যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন হয়েছে। এই ট্রাইব্যুনাল ঘিরে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারÑ স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা স্বজন হারিয়েছেন, বিচার প্রত্যাশিত গোটা জাতির একটা স্বপ্ন জড়িয়ে আছে। হঠাৎ করে আমরা লক্ষ্য করলাম, জানতে পারলাম ১৮ আগস্ট, ৩১ অক্টোবরের মধ্যে এই ট্রাইব্যুনাল সরিয়ে নিতে হবে। কারণ হিসেবে বলা হলোÑ অফিসে বিচারক, কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের বসার জায়গা হচ্ছে না। এই জায়গাটা লাগবে। এটা আমাদের খুবই আহত করেছে, ক্ষুব্ধ করেছে। কারণ রেজিষ্টার, প্রধান বিচারপ্রতি দ্বারা আদৃষ্ট হয়ে এই সিদ্ধান্তটি জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল বা সরকারকে। মাননীয় প্রধান বিচারপ্রতির কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা ছিল। তিনি যখন প্রধান বিচারপ্রতি হিসেবে নিয়োগ পেলেন, তখন সরকারকে আমরা অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। এই প্রথমবার বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের একজন হিসেবে তিনি প্রধান বিচারপ্রতির আসনে বসলেন। এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উজ্জ্বর্ল করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দায়বদ্ধতাও প্রমাণিত হয়েছে। আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপ্রতি, সংবিধানের যিনি রক্ষক তিনি সংবিধানে যেসব অসংগতি রয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি যা সাংঘর্ষিক এসব অপসারণের উদ্যোগ নেবেন এমনটি আশা করি আমরা।
এক প্রশ্নের জবাবে শাহরিয়ার কবির বলেন, আমরা মাননীয় প্রধান বিচারপ্রতি বা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপ্রতি, যারা আমাদের অভিভাবক, সংবিধানের অভিভাবক, ট্রাইব্যুনালের অভিভাবক তাদের একটা কথা মনে করিয়ে দিতে চাইÑ এই বিচারটি আটদশটা মামুলি ঘটনার বিচার নয়। এটি একটা গণহত্যার বিচার। গোটা জাতি, রাষ্ট্র এই বিচারের জন্য চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করছে। শহীদ পরিবারের রক্তক্ষরণ এখনো বন্ধ হয়নি। আপনারা এমন কিছু করবেন না, যাতে শহীদ পরিবারের যন্ত্রণা প্রশমিত হওয়ার পরিবর্তে রক্তক্ষরণ আরও বাড়ে। ট্রাইব্যুনাল সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত বা ট্রাইব্যুনাল যদি সরিয়ে নিতেই হয়, কবে নতুন জায়গায় ট্রাইব্যুনাল বসবে, নতুন উদ্যোমে কাজ শুরু হবে তা আমরা জানি না। এতদিন আমরা বাঁচব কিনা তাও নিশ্চিত নই।
তিনি আরও বলেন, ২০১০ সালের ২৫ এপ্রিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করার আগে থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য দেশ-বিদেশে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সহযোগিরা বহুমাত্রিক চক্রান্ত আরম্ভ করেছে। ২০১০ ও ২০১১ সালে তারা ঢাকায় বড় বড় সেমিনার, সম্মেলন করেছে। এই বিচার সচ্ছ বা মানসম্পন্ন হবে না, ন্যায়বিচার পাবে নাÑ এ রকম অভিযোগ তুলে তারা একটি জনমত তৈরি করতে চেয়েছে। আমরা দেখেছি, ২০১১ সালে শীর্ষস্থানীয় গণহত্যাকারী, বহুল আলোচিত মীর কাসেম আলী ২৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে আমেরিকাতে একটি লবিং ফার্ম ভাড়া করে। যার মূল কাজ, এই বিচার বানচাল করা, বিচারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা। হরতাল-অবরোধ যাবতীয় কিছু সংগঠিত করেছে প্রধানত বিচারটি বানচাল করার জন্য। যেহেতু এই বিচারটি করার উদ্যোগ নিয়েছে শেখ হাসিনা সরকার, সেই সরকারকে উৎখাত করাই ছিল তাদের নানামুখি ষড়যন্ত্র।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জামায়াতিরা ষড়যন্ত্র করবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সরকার বা প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রেও যে জামায়াত অবস্থান করছে এমনটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শুরুর দিক থেকেই লক্ষ্য করছি। বিচার শুরু হওয়ার আগেই, যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ টাইব্যুনালে তদন্ত সংস্থায় যত লোক নিয়োগ করা হলো, সংস্থার প্রধান হিসেবে জামায়াতের একজনকে নিয়োগ দেওয়া হলো! আমরা তখন এ নিয়ে অনেক হৈ চৈ করলাম। তার নিয়োগ বাতি করা হলো। জামায়াতিদের ষড়যন্ত্র প্রাথমিকভাবে পরাজিত হলো। তারপর দেখলাম, বিচারের স্থান কি হবে। এই স্থান নিয়েও আমাদের সঙ্গে সরকার কিংবা প্রশাসনের নানারকম টানাপোড়েন হয়েছে। ২০০৯ সালে তো উনারা ঠিক করেছিলেন আব্দুল গণি রোডে একটা টিনের ছাপরা আছে, যেখানে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল বসে, সেই টিনের ছাপরায় তারা ট্রাইব্যুনাল গঠন করবেন।
ঘাতক-দালাল নির্মূল ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আরও বলেন, আমরা বারবার বোঝানের চেষ্টা করেছি, এটা কোনো সাধারণ ট্রাইব্যুনাল নয়। এই ট্রাইব্যুনালে প্রথমবারের মতো একটা দেশ, দেশীয় আইনে, দেশীয় বিচার ব্যবস্থায় কতগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধে অভিযুক্তদের বিচার করবে। স্বাভাবিকভাবেই এই বিচারের দিকে আন্তর্জাতিক একটা মনোযোগ থাকবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের। বিচারটি ঠিকমতো হচ্ছে কিনা তা নজরদারি করার জন্য বহু সংস্থা, সংগঠন আসবে। সুতরাং ট্রাইব্যুনাল এমন একটি জায়গায় হতে হবে, যাতে বোঝা যায়, এই বিচারটি সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে বিচার সম্পর্কে একটা সম্ভ্রমের বোধ উদয় হয়। আমরা এমনটিও বলেছিলাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য মিত্রশক্তির ৩ মাস লেগেছিল স্থান নির্বাচন করতে।
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন