বাংলাদেশ উন্নয়নের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
‘দিন বদলের অঙ্গীকার’ নিয়ে একটি সার্বজনীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর, সমৃদ্ধ, উন্নত ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে নিয়ে ‘রূপকল্প ২০২১’ ঘোষণা করে কাজ শুরু করে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ‘রূপকল্প ২০২১’ এর মাধ্যমে জনগণকে উজ্জ্বল সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে এবং বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের যুবসমাজ এর মধ্যে তাদের চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ খুঁজে পায়। প্রায় ৬০ বছর আছে ওয়াশিংটন শহরে মার্কিন মানবতাকর্মী রেভারেন্ড ড. মার্টিন লুথার কিং অবহেলিত মার্কিন জনগোষ্ঠীকে আলোর ইশারা দেখিয়েছেন ও বলেছিলেন ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ এমনভাবে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণকে একটি সুস্পষ্ট ‘রূপকল্প ২০২১’ উপহার দিয়ে তার একটি ‘স্বপ্নের কথা’ বলেছিলেন এবং এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে গত সাড়ে ৭ বছরের উন্নয়ন কর্মকা-ে। আন্তর্জাতিক মহলে আমাদের এই সফলকার বাস্তব গল্প অনেকাংশে স্বীকৃতি পেলে ও দেশের মাটিতে সাধারণ জনগণের কাছে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিগুলো অনেক ধরনের বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান দেশিয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে একটি নতুন অবস্থানে স্থান পেয়েছে, তবুও তার পেছনের গল্পটি অর্থাৎ কিভাবে সার্বিক এই অগ্রগতি এগিয়ে যাচ্ছে তা সকলের কাছে পরিষ্কার নয় বা আমরা আমাদের সফলতার গল্পটি সকল শ্রেণিপেশার মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারিনি।
স্বাধীনতার গত ৪৫ বছরের মধ্যে ১৯ বছরই সামরিক ও বেসামরিক লেবাসে জেনারেল জিয়া ও বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি শাসন, ৯ বছর জেনারেল এরশাদের সামরিক আবরণে জাতীয় পার্টির শাসন, ২ বছরের জেনারেল মঈন ও ফখরুদ্দিন আহমদের সামরিক শাসন এবং ১৫ বছর আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সরকারের শাসন। এর মধ্যে স্বাধীনতাউত্তর প্রথম সাড়ে তিন বছরে দেশ পুনর্গঠন ছিল একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব। স্বাধীনতাউত্তর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের কয়েকটি ঐতিহাসিক দায়িত্বের মধ্যে অন্যতম ছিল:
হ বাংলাদেশের সংবিধান রচনা।
হ নতুন দেশের জন্য প্রথমবারের মতো প্রশাসনিক কাঠামো গঠন ও দায়িত্ব প্রদান।
হ ধ্বংসপ্রাপ্ত যোগাযোগ ও সফল প্রকার অবকাঠামো তৈরি ও চালু।
হ নতুন দেশের অর্থনৈতিক কর্মকা- চালু করা এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো ও পরিকল্পনা গ্রহণ।
হ অভিজ্ঞতাবিহীন প্রাদেশিক সরকারের কাজ করা স্বল্পসংখ্যক কর্মকর্তা ও কর্মচারী দিয়ে প্রশাসন সাজানো ও পরিচালনা।
হ প্রায় দুই বৎসর পর পাকিস্তান থেকে ফিরে আসা কর্মকর্তা এবং সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দেশের চলমান প্রশাসনে একীভূতকরণ।
হ বিশ্বের অনেক ধনী দেশের বৈরি অবস্থানের কারণে দেশ পুনর্গঠনে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রাপ্তিতে ধীরগতি এবং উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালনা ও অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যস্ততা; এবং পাকিস্তানসহ কয়েকটি রাষ্ট্রের বিরোধিতার মুখে স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্বসভায় বিভিন্ন ফোরাম ও দেশ থেকে স্বীকৃতি আদায়।
একটি নতুন দেশের ভীত স্থাপনে আমাদের অভাবনীয় সাফল্যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বাধীনতা বিরোধী চক্র এবং তাদের দেশিয় দালালরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাসহ তার পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনদের খুন করে ইতিহাসের চাকাকে পিছনের দিকে নিয়ে যাবার কাজ শুরু করে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নতুন দেশটিকে গড়ে তোলার অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিয়ে ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে সামরিক সরকারের সময় সামরিক অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের পুনর্বাসন, স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতকরণ, জাতির পিতার খুনিদের রক্ষাকারীদের বাঁচানোর জন্য ইনডেমিনিটি বিলের মতো সাংবিধানিক পরিবর্তন এবং সার্বিকভাবে একটি পরনির্ভর অর্থনীতির চর্চা দেশকে পশ্চাৎপদ করে রাখে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতীগোষ্ঠীকে দাবিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের সামরিক ও বেসামরিক উস্কানি দিতে থাকে তৎকালীন সরকার। এছাড়াও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীদের বিভিন্নভাবে সহায়তা এবং তাদের দেশিয় অনুচরদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্রসরবরাহসহ অনেক ধরনের স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকা-ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা প্রদান করে।
আরেক সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ ১৯৮২ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে উপজেলা ব্যবস্থা চালু করেন। তবে তার সময়ে ও তার পূর্বসুরী জেনারেল জিয়ার অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে স্বল্পমেয়াদি চিন্তা ও পরনির্ভরতার ছাচ ছিল খুবই স্পষ্ট। দুই সামরিক সরকারের আমলেই সেনাছাউনী থেকে রাজনৈতিক দল তৈরির উদ্যোগ প্রায় একই ধরনের এবং এরই ফলশ্রুতিতে বিএনপি (জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে) এবং জাতীয় পার্টির (জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বে) জন্ম হয়। তাই চারিত্রিকভাবে দুটি দলই অভিন্ন এবং এসব দলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের দলছুট নেতা ও কর্মী। সুবিধাবাদী, স্রোতমুখী রাজনৈতিক ও স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তিদের এসব দলে যোগদান লক্ষণীয়। এছাড়াও বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীসহ পাকিস্তান ভাবধারায় বিশ্বাসীদের যোগদান। সাম্প্রাদায়িক, স্বাধীনতাবিরোধী ও কিছু ধর্ম ব্যবসায়ীদের (ধার্মিক নয়) সরব উপস্থিতিও ছিল লক্ষণীয়। ১৯৯০ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের পর ১৯৯১ সালে সুক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন এবং আওয়ামী লীগের কর্মীদের উপর বিভিন্ন ধরনের মামলা-হামলা ও জেল-জুলুম নির্যাতন চালায়। অপরদিকে অর্থনীতিতে কোনো প্রকার পরিবর্তন বা নতুন ধরনের পরিবর্তনের চিন্তা না করে স্বাধীনতা বিরোধিদের পুনর্বাসনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই সময়েই তথ্য প্রযুক্তিতে ফাইবার অপটিকস সংযোগের মতো আন্তর্জাতিক প্রস্তাব বিএনপি অপরিপক্ক ও অবিবেচনা প্রসূত সিদ্ধান্তের ক্ষত জাতিকে দীর্ঘদিন বহন করতে হয়। এই সময়েই প্রশাসনকে দলীয়করণের ব্যাপক প্রসার এবং বিদেশ নির্ভর একটি অর্থনীতি গড়ার চর্চায় ব্যাপক প্রসার ঘটে।
১৯৯৬ সালে আরেকটি স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রায় ২১ বৎসর পর আবারও রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেই কয়েকটি মৌলিক জাতীয় সমস্যার সমাধান করেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো :
হ পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর।
হ গঙ্গার পানি বন্টনের নিয়ে আলোচনা ও ফারাক্কা করার লক্ষ্যে কার্যক্রম গ্রহণ।
হ জাতির পিতার খুনিদের বিচার সম্পন্ন করে শাস্তি প্রদান।
হ কৃষিখাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে ব্যাপক কর্মসূচি।
হ স্বাস্থ্যখাতে গ্রামীন জনগণের জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন।
হ শিক্ষাখাতে মেয়েদের জন্য উপবৃত্তির ব্যাপক প্রসার, দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা খরচে শিক্ষা এবং কারিগরি শিক্ষার প্রসারে কর্মসূচি।
হ সেবাখাতকে প্রাধান্য দিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টির উদ্যোগ।
হ ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আনয়নের লক্ষ্যে ব্যবসা ও শিল্পবান্ধব নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।
হ প্রশাসনকে আধুনিককরণ এবং তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহ প্রদান।
২০০১ সালের নির্বাচনে আবারও বিএনপি ক্ষমতায় আসে ব্যাপক কারচুপি ও ভয়ভীতি তৈরি করে। এই সময়েই প্রকাশ্য দিবালোকে আওয়ামী লীগ নেতা আহসান উল্লাহ্ মাস্টার এমপি, শাহ এম এস কিবরিয়া এমপি হত্যা ব্রিটিশ হাই কমিশনারের উপর গ্রেনেড হামলা, জাতীয় নেতৃত্বকে চিরতরে ধ্বংস করার লক্ষ্যে ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলা, সারাদেশে ৫০০ এর অধিক স্থানে সিরিজ বোমা হামলাসহ অনেক রাষ্ট্রবিরোধী ঘটনার নেপথ্যের নায়ক হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। সংখ্যালঘু নির্যাতন, অর্থনৈতিক কর্মকা-ে ব্যাপক অস্বচ্ছতা- লুটপাট, বিদ্যুতায়নের নামে খাম্বা স্থাপন, হাওয়া ভবনের নামে আর্থিক সুবিধা আদায়ে সমান্তরাল সরকার চালনা; ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক অবলোপন ও শুন্য সুদে ৩০ বৎসর পর্যন্ত হাজার হাজার কোটি টাকা পুনঃভরণ, বিদেশে মুদ্রা পাচারসহ বিভিন্ন ধরনের আর্থিক অনিয়ম এবং ব্যাংক ও আর্থিক খাতকে যোগপোযোগী ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর করতে ব্যর্থতা জাতীয় জীবনে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন