প্রতিটি মানুষ অসীম শক্তি আর সম্ভাবনার আধার
প্রকৌশলী আহসান হাবীব লেলিন
নীলফামারী দেশের অবহেলিত জেলাগুলোর একটি। খুব ছেলেবেলা থেকেই দেখেছি অশিক্ষা, দারিদ্র,
অনগ্রসরতা, বিজ্ঞানহীনতা, কুসংস্কার এই এলাকায় আলো দেখতে দেয় না। আমরা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। লোকে আমাদের ‘মফিজ’ বলে। যখন একটু বড় হলাম, বুঝতে শিখলাম শিক্ষার বিকল্প কিছু নেই। বাবা অধ্যাপক, এলাকায় সবাই বাবাকে সম্মান করে। আমাদের বাড়িটাকে প্রফেসরের বাড়ি বলে ডাকে। সমীহ করে সবাই। ভালো ছাত্র হবার কারণে প্রকৌশল বিদ্যায় পাঠ নেবার সুযোগ পেয়েছি। প্রকৌশলী হয়েছি। বাবা-মাও আনন্দিত, ছেলে প্রকৌশলী।
নিজের যোগ্যতায় সরকারি চাকরি পেয়েছি। চাকরি করে নিজের উপার্জনের সুযোগও হয়েছে। মাস গেলে মাইনে পাচ্ছি। সরকারি প্রকৌশলী, সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি। কিন্তু আমার এলাকার সেই নিরন্ন, শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত পিছিয়ে পড়া, পা ফাটা মানুষদের কী হবে, যাদের লোকে ‘মফিজ’ বলে? ভাবনার ভূত আমার পিছু ছাড়ে না। কি করব? কি করা যায়? কি করতে পারি এই মানুষদের জন্য? ভাবতে থাকি। ভাবতে থাকি। ভাবতে থাকি।
সরকারি চাকরি ছাড়ি। ব্যবসা শুরু করি কাছের কয়েক বন্ধুকে নিয়ে। টার্গেট আমার এলাকা, সেই পা ফাটা ‘মফিজ’দের কিভাবে জীবন মানের উন্নতি করা যায়। কিভাবে তাদের জন্য একটু উপার্জনের ব্যবস্থা করা যায়, যাতে তাদের জীবনের চাকা একটু হলেও সচল হয়। একটু হলেও সচ্ছলতার মুখ দেখতে পারে তারা। পোল্ট্রি দিয়ে শুরু করলেও ধীরে ধীরে আরও শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবার চেষ্টা করি। যাতে আমার এলাকার লোকে কাজ করতে পারে, তাদের উপার্জন বাড়ার সুযোগ তৈরি হয়। আমার অবহেলিত নীলফামারীর দর্শনীয় স্থান নীলসাগর। তাই নীলসাগর নামেই কোম্পানির নামকরণ করি। অন্তত আমার এলাকাকে তো চিনবে লোকেÑ এ ভাবনা থেকে। জানবে দেশের মানুষ নীলসাগর নামে একটি অবহেলিত এলাকা রয়েছে, নীলফামারীর অধীন। জানবে নীলফামারীকেও। ধীরে ধীরে সুযোগ আসতে থাকে, সুযোগ বাড়তে থাকে কাজের। মানুষকে কাজে লাগানোর। বরাবরই চেষ্টা করেছি নিষ্ঠা, আন্তরিকতা আর সততা নিয়ে কাজ করে একটি মানোত্তীর্ণ পর্যায়ে যেতে।
আমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলি। শিক্ষার সুযোগ থেকে আমার এলাকার মানুষ, আমরা যারা অবহেলিত তারা যেন বঞ্চিত না হই। হয়তো কোনো একটি ছেলে বা মেয়ে আমার চেয়েও ভালো, বড় প্রকৌশলী হবে। হয়তো আমি যে সুযোগ পেয়েছি উচ্চশিক্ষার সেই সুযোগ, তার জীবন বদলে দেবে। কেউ জানে না কার ভেতর কি প্রতিভা লুকিয়ে আছে। আমি সেই সুযোগটি করে দেবার চেষ্টা করছি মাত্র।
নীলসাগর এখন অনেক লোকের প্রতিষ্ঠান। অনেক লোকের কর্মসংস্থান। ‘কাজ করি দেশ গড়ি’ এই সেøাগানে আমরা বিশ্বাসী। নীলফামারী এলাকার একসময়ের অবহেলিত, বঞ্চিত, নিরন্ন মানুষেরাই এখন কর্মঠ ও গুরুত্বপূর্ণ। তারা এখন উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। আমি চেয়েছি অবহেলিত মানুষদের, গুরুত্বহীন মানুষদের গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে। তাদেরকে কাজের সঙ্গে যুক্ত করতে। জগতের প্রতিটি মানুষ অসীম শক্তি আর সম্ভাবনার আধার। আমরা অবহেলা করি মানুষকে। তার ভেতরের শক্তিটি আবিষ্কার করতে চাই না। কেবল অভিজ্ঞ লোক খুঁজি। আমি অনভিজ্ঞ মানুষদের অভিজ্ঞ করে তুলেছি কাজের সুযোগ দিয়ে, ট্রেনিং দিয়ে।
শুরুতেই বলেছিলাম, শুধু নিজের কথা কখনও ভাবিনি। এখনও ভাবি না, ভাবতে পারি না। অনেককে নিয়ে ভালো থাকতে পারাটাই, কাজের মধ্যে থাকতে পারাটাইÑ আমার কাছে ভালো থাকা। হয়তো সামর্থ্য সীমিত কিন্তু স্বপ্নটা বড়ই থাকতে হয়। আমি জেগে থেকেই স্বপ্ন দেখি। যে স্বপ্ন আমাকে জাগিয়ে রাখেÑ আরও অনেক বেশি মানুষকে যুক্ত করব কাজের সঙ্গে, উৎপাদনের সঙ্গে। যদি নীলফামারীর মতো ক্ষুদ্র একটি এলাকা, অল্পকিছু মানুষের জীবনের ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারি সেটাই বা কম কি। এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য এলাকা নিয়েই তো বাংলাদেশের সৃষ্টি।
লেখক : চেয়ারম্যান, নীলসাগর গ্রুপ
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন