বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িক ভাবনা শেষ
১৯৭৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু আলজেরিয়ায় যান। সেখানে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘পৃথিবী দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগে শোষক শ্রেণি আরেক ভাগে শোষিত শ্রেণি, আমি শোষিতের দলে।’ এই ভাষণের পরে কিউবার তখনকার রাষ্ট্রপতি, কিংবদন্তি বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ট্রো শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেছিলেন, ‘তুমি আজ যে ভাষণ দিয়েছ, তারপর থেকে সাবধানে থেকো। আজ থেকে তোমাকে হত্যার জন্য একটি বুলেট তোমার পিছু নিয়েছে।’ ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সেই আশঙ্কা সত্য হলো, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুকে প্রাণ দিতে হলো।
একটি দেশের কাক্সিক্ষত উন্নয়নের জন্য জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এটা বঙ্গবন্ধু হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন। ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তিনি লক্ষ লোকের জনসভায় বলেন, ‘আমি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিতে চাই, আমাদের দেশ হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক দেশ। এদেশের কৃৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সবাই সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।’ বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষকে যেমন ভালোবাসতেন, তেমনি ভালোবাসতেন বাংলার জল ও মাটিকে। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সহজ-সরল জীবনযাপন করতেন। অর্থ, বিত্ত ও ক্ষমতার প্রতি তার কোনো লোভ-লালসা ছিল না। তিনি সংগঠনের কাজের জন্য হাসিমুখে মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করেছিলেন। তিনি বাংলা ও বাঙালির স্বার্থের ব্যাপারে কারও সঙ্গে কোনোদিন আপস করেননি।
বঙ্গবন্ধু ১৯৪৬, ১৯৪৭ ও ১৯৫০ সালে কলকাতায়, নোয়াখালী ও বিহারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহতা নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন। ধর্মের ভিন্নতার কারণে মানুষ কত নিষ্ঠুর হতে পারে, দাঙ্গায় কত নিরপরাধ মানুষ মারা যায়, আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা তিনি ভালোভাবে উপলব্ধি করেছেন। তাই তিনি চাননি তার বাংলাদেশে কেউ ধর্মের নামে মানুষ হত্যার রাজনীতি করুক। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াক। বঙ্গবন্ধু সাম্প্রদায়িকতাকে ভীষণভাবে ঘৃণা করতেন। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’Ñ চন্ডিদাসের এ অমর কথাটি তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। তিনি লালন ফকির, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে মানুষ হিসেবেই মূল্যায়ন করতেন। তার কাছে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। সবাই এক বাংলা মায়ের সন্তান। তিনি বলতেন, ‘আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেক নেতা আছে, যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে; এবং তারা জানে সমাজতন্ত্রের পথই একমাত্র জনগণের মুক্তির পথ। ধনতন্ত্রের মাধ্যমে জনগণকে শোষণ করা চলে। যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তারা কোনোদিন কোনো রকমের সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করতে পারে না। তাদের কাছে মুসলমান, হিন্দু, বাঙালি, অবাঙালি সকলেই সমান।’ এতেই বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধু সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা সম্পর্কে কতটুকু সচেতন ও দূরদর্শী ছিলেন।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।’ ‘যার যার ধর্ম তার তার’ ধর্মনিরপেক্ষতার এই ব্যাখ্যা বঙ্গবন্ধুই প্রথম উপস্থাপন করেন। ওই বছর ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলেছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না। ২৫ বছর ধর্মের নামে জুয়াচুরি, শোষণ, বেঈমানি, খুন, ব্যাভিচার এই বাংলাদেশের মাটিতে চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।’
১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর পুরনো ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের তৃতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ করা হয়। কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু এ মর্মে প্রস্তাব উত্থাপন করেন, যা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হয়। এর ফলে ধর্ম-নির্বিশেষে সবার জন্য দলের দ্বার উন্মোচিত হয়। সেই সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু তার সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে বলেন, ‘আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে একথা ঘোষণা করতে পারি, দেশের সকল ধর্মের, সকল বর্ণের এবং সকল ভাষাভাষী মানুষকে একটি গণপ্রতিষ্ঠানে সমবেত করা প্রয়োজন। বস্তুত, আওয়ামী লীগ দলকে সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য অবারিত করার মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের প্রগতিশীল ভূমিকাকে অক্ষুণœ রাখতে সক্ষম হব।’ পরে ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে পাকিস্তানকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ ঘোষণা করা হলে এর তীব্র বিরোধিতা করে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান শাসনতান্ত্রিক পরিষদে তার ভাষণে বলেন, ‘পাকিস্তান শুধু মুসলমানদের জন্য সৃষ্টি হয়নি।’
বঙ্গবন্ধু আজন্ম অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীনভাবে লড়াই করে গেছেন। একটা সত্যকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন, তা হচ্ছে শোষণহীন সমাজ, সাম্যমূলক সমাজ, কৃষক-শ্রমিক মুক্তির সমাজ। তিনি বাঙালি জাতীয়তা, বাঙালি সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সবার অজান্তে পাকিস্তান সমর্থক এবং সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র মেতে ওঠে। ১৯৭৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের উন্মুক্ত উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রদত্ত তার বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা শাসনতন্ত্র দিয়েছি। এর মধ্যে কোনো ঘোরানো ফেরানো কথার সুযোগ নেই। শাসনতন্ত্রে আমরা চারটি নীতিকে মেনে নিয়েছিÑ জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। আমি যা মনে করি, আলজিয়ার্স কনফারেন্সে যেটা আমি বলেছিলাম, দুনিয়া আজ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। একটি শোষক, আরেকটি শোষিত। শোষিতের পক্ষে যারা থাকে, আর শোষকের পক্ষে যারা থাকেÑ তারা কে, তারা কারা, সে কথা দুনিয়ার মানুষ জানে। …সমাজতন্ত্র আমাদের প্রয়োজন। সমাজতন্ত্র না হলে এ দেশের দুঃখী মানুষের বাঁচবার উপায় নেই। আমরা শোষণহীন সমাজতন্ত্র চাই। …সমাজতন্ত্রের রাস্তা সোজা নয়। সমাজতন্ত্র করতে হলে যে ক্যাডারের দরকার, তা আমরা করতে পেরেছি কিনা এ নিয়ে আলোচনার দরকার আছে। …সমাজতন্ত্রের রাস্তায় আমরা যে পদক্ষেপ নিয়েছি, তা থেকে আমরা পিছু হটতে পারি না, পারব নাÑ যত বড় ষড়যন্ত্রই চলুক না কেন।’ এরকম অসংখ্য বক্তব্য আছে তার। বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে পাঠ করতে হবে। তার আদর্শ ও নীতিকে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতি ফিরিয়ে আনাই হবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমাদের যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শন। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’Ñ এ গ্রন্থখানা যারা তার নামে রাজনীতি করেন তাদের অবশ্য পাঠ করা উচিত বলে মনে করি। মাঝে মাঝে তাদের পড়া ধরা উচিত। না পড়ে পড়ে ভাওতাবাজির, ফটকাবাজির, চাপাবাজির ‘রাজনীতিতে’ আমরা শেষ হয়ে গেলাম।
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন