বাংলাদেশ উন্নয়নের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ২
সর্বোপরি কেয়ারটেকার সরকার কাঠামো নিয়ে নাটক ও ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনের করুণ পরিণতিতে জেনারেল মঈন উদ্দিন ও ফখরুদ্দিনের নেতৃত্বে সামরিক সরকার খালেদা জিয়ার শাসনের সময়ে সংগঠিত দুর্নীতি দমন ও নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার অঙ্গীকার নিয়ে এসে বিরাজনীতিকরণে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে এই সামরিক সরকার তাদের শাসন প্রলম্বিত করার লক্ষ্যে বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে একইভাবে বিবেচনা শুরু করে। এই সময়ে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের ব্যাপকভাবে ধর-পাকড় ও নির্যাতন ছিল লক্ষণীয়। এই দুই বছরে অর্থনীতির চাকাকে কিছুটা মূল সড়কে নিয়ে আসলেও কোনো ধরনের মৌলিক পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়। তবে জনগণের দাবি ও চাপের কাছে মাথানত করে দুই বছরের মাথায় একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। এই জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয় লাভ করে ক্ষমতা গ্রহণ করে।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আবারও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণ ছিল একটি যুগান্তকারী পরিবর্তনÑ ‘দিন বদলের অঙ্গীকারের সূচনার শুভলগ্ন।’ এই নির্বাচনের পূর্বে ঘোষিত ‘রূপকল্প ২০২১’ এবং এরই উপরে ভিত্তি করে ঘোষিত নির্বাচনি ইশতেহার জনগণ সর্বাত্মকভাবে সমর্থন করে ভোটের মাধ্যমে। ‘রূপকল্প ২০২১’ এর মাধ্যমে ঘোষিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার ঘোষণা যুব সমাজের কাছে প্রজন্মের দাবি হিসেবে বিবেচিত হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ঘোষণায় জনগণের ‘কলঙ্ক মোচনের শুভ ইঙ্গিত হিসেবে ধরে নেয়। এছাড়াও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন, সেবাখাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ও নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করে জনগণের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে খাতভিত্তিক সুস্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার ‘পথ রেখা’ তৈরি করা হয়। একই সময়ে স্বাধীনতাবিরোধী বিএনপি ও জামায়াত জোট মরিয়া হয়ে নানা চক্রান্তে লিপ্ত হয়। চক্রান্তকারীরা বিডিআর বিদ্রোহসহ নানা পরিস্থিতির সৃষ্টির মাধ্যমে একটি অকার্যকর ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে দেশে ও বিদেশে পরিচিত করে তুলতে চায়। সরকার কঠোরভাবে স্বাধীনতা ও প্রগতী বিরোধিদের দমনে সচেষ্ট হয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন খুন, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনকারীদের বিচার করে শাস্তি বাস্তবায়ন শুরু করার পরই বিএনপি-জামায়াত জোট বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করার পর জামায়াত-বিএনপি জোট যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ করা এবং নির্বাচন না করে ক্ষমতায় যাওয়ার নীলনকশা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ সময়ে হরতাল, অবরোধ এবং বিভিন্ন ধরনের হিংসাত্মক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে এবং দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করার লক্ষ্যে পণ্য পরিবহনে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে বাধা প্রদান করে। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে যথাসময়ে নির্বাচন করে। বিএনপি-জামায়াত জোট নির্বাচনে যোগদান না করে নির্বাচনকে বাধাগ্রস্থ করার চেষ্টা করে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আবারও জনগণের ম্যানডেট পায় আওয়ামী লীগ। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোটের চক্রান্ত না থামিয়ে বিভিন্ন ধরনের হিংসাত্মক কার্যক্রম চালিয়ে যায়।
বিএনপি-জামাত জোটের ধ্বংসাত্বক কার্যক্রমের ফলশ্রুতিতে দেশের অর্থনীতি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়, জনজীবনের ভয়ভীতি এবং নৈরাজ্য সৃষ্টির অপচেষ্টা করা হয় এবং উন্নয়ন কর্মকান্ডকে ক্ষতিগ্রস্থ করার লক্ষ্যে দেশে-বিদেশে প্রচারণা এবং অর্থ খরচ করে দাতাদের দ্বারে-দ্বারে ঘুরে অপপ্রচার চালান করে জামায়াত-বিএনপি জোট। জামায়াত-বিএনপি জোট এই সময়ে ৭ জন মার্কিন সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানের স্বাক্ষর জাল করে বাংলাদেশ সরকার বিরোধী বিভিন্ন প্রচারণা, ভারতীয় বিজেপি নেতার বক্তব্য বিবৃতিকে বিকৃত করে তাদের পক্ষে চালানোর চেষ্টা, বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা এবং এ ধরনের নানাভাবে মিথ্যা প্রচারণা চালানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেও আন্তর্জাতিক মহলে তাদের দেউলিয়াত্ব প্রমাণ করে। এসব কর্মকা- পরিচালনায় লন্ডনে অবস্থানকারী বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্দেশনা এবং পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর সংযোগ ছিল বলে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন। এই সময়ে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরকর্তৃক পালিত অবরোধ ও হরতালে ধ্বংসযজ্ঞে (০৬ জানুয়ারি ‘১৫ থেকে ১৩ এপ্রিল ‘১৫ পর্যন্ত) সারাদেশে ৯৭ দিন অবরোধ ও ৪৩ দিন হরতাল সংঘটিত করে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম পরিচালনা করে যার সংক্ষিপ্ত খতিয়ান নিম্নে প্রদান করা হলো :
হ ১৫৭ জন নিরীহ নাগরিক হত্যা করা হয়।
হ ৫০৮ জন আগুনে পুড়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়।
হ ৬৬৯ জন অন্যান্য কারণে আহত হয়।
হ ১৭৬৫টি গাড়ি পোড়ানো হয়।
হ ১১৩৮টি গাড়ি ভাংচুর হয়।
হ ১৮টি রেলগাড়িতে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালানো হয়।
হ ০৮টি লঞ্চে আগুন লাগানো হয়েছে।
হ ৭০টি সরকারি অফিস/স্থাপনা ভাঙচুর করা হয়।
হ ৬টি ভূমি অফিসে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
হ ১৬টি আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাঙচুর করা হয়।
হ ২০ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়ি-ঘর ভাঙচুর করা হয়।
হ ২৩টি সংখ্যালঘু পরিবারের উপর হামলা করা হয়।
ককটেল ও পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করার সময় ৫৭৯ জন বিএনপি ও জামায়াত-র্শিবির কর্মীকে হাতেনাতে ধরা হয়েছে। যার মধ্যে বিএনপির ৩৬৩, জামায়াতের ২০৫, অন্যান্য ১১ জন কর্মী হাতেনাতে ধরা পড়ে।
বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে বড় বাধা অপ্রতুল অবকাঠামো, অর্থায়ন বাধা, আমলাতান্ত্রিক বিলম্ব, অপ্রতুল গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থা। এছাড়াও দুর্নীতি, ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা, এবং আইনি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কালক্ষেপণও বাংলাদেশের দ্রুত উন্নয়ন ও বিনিয়োগে আস্থা সৃষ্টিতে বাধা হিসেবে কাজ করছে। তাই এই মুহূর্তে জরুরি প্রয়োজনÑ এসব বিনিয়োগ প্রতিবন্ধকতাগুলোকে সমাধান করা। বাংলাদেশের অর্থনীতির গত সাড়ে সাত বছরে কয়েকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নিম্নে তুলে ধরছি :
হ মাথাপিছু আয় প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি।
হ আমদানি ও রপ্তানি তিনগুণের অধিক বৃদ্ধি।
হ দারিদ্রসীমার নিচে মানুষ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে।
হ প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিটেন্স তিনগুণ বৃদ্ধি।
হ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পাঁচগুন বৃদ্ধি।
হ রাজস্ব আহরণ তিনগুণের অধিক বৃদ্ধি।
হ জাতীয় বাজেটের আকার পাঁচগুন বৃদ্ধি।
হ বিদ্যুৎ উৎপাদন তিনগুণ বৃদ্ধি।
হ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ।
হ প্রতি বৎসর ত্রিশ কোটির উপরে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বই বিতরণ।
হ যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক কর্মযজ্ঞ।
হ সমুদ্র বিজয়ের মাধ্যমে দেশের আয়তন দ্বিগুন করল। এবং
হ ব্যাপক সম্পদ সংগ্রহের অবস্থা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ সার্বিকভাবে তার উন্নয়ন কার্যক্রমকে গতিশীল করার লক্ষ্যেই জনগণের ক্ষমতায়ন করে শান্তি ও উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার এই যাত্রায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার ও একে সহজলভ্য করা, পরিবেশ উন্নয়ন ও বৈস্মিক উষ্ণতার মোকাবিলা করার লক্ষ্যে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রশংসিত হয়েছে। সার্বিকভাবে ‘জনগণের ক্ষমতায়নে বিশ্ব শান্তির দর্শনের’ প্রবক্তা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তে জলবায়ু পরিবর্তনের কার্যক্রমে নেতৃত্বের জন্য জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘চ্যাম্পিয়ন্স অব দি আর্থ’ পুরস্কার পেয়েছেন। এছাড়াও গত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তিনি ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আই টি ইউ) ‘আই সি টি সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট এ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন। এর আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ২০১৪ সালে ইউনেস্কোর ‘পিস ট্রি’ পুরস্কার প্রাপ্তি বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীশিক্ষার প্রতি তার অঙ্গীকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। গত কয়েকবছরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জনবান্ধব কার্যক্রম বিশ্বব্যাপী প্রসংশিত হয়ে দেশের জন্য যেসব সম্মান বয়ে এনেছে তার জন্যই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মহলে একটি সম্মানজনক অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেছে। এখন আর দেশটিকে ‘বটমলেস বাস্কেট’ হিসেবে দেখা যায় না বা সামরিক স্বৈরতন্ত্রের দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় না, বন্যা, ঘুর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের গরিব দেশে হিসেবে বিবেচিত হয় না। এখন বাংলাদেশ উন্নয়ন ও উদ্ভাবনী কার্যক্রমের দৃষ্টান্ত বা মডেল হিসেবেই বিবেচিত হয়। আমরা বাঙালি জাতি এরই জন্য গর্বিত।
বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির জন্য ইতিবাচক পূর্বাভাস সরকারের গতিশীল অর্থনীতি নিয়ে যাদের সংশয় আছে তাদেরকে নিরুৎসাহিত করবে। অতীতের যেকোনো সময় থেকে এখন বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি সুদৃঢ় অবস্থানে আছে বলে আমরা মনে করি। তবে উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোকে সবসময়ই নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয় এবং এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও কোনো ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নে অধিকতর সক্ষমতা অর্জন, বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করণ, সড়ক ও রেল যোগাযোগ উন্নয়নসহ অবকাঠামো উন্নয়ন, গ্যাস সংকট, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং সকল ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণ প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি আনয়নের লক্ষ্যে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ প্রদানের জন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতার উত্তরণ ঘটিয়ে বেসরকারি কার্যক্রম উৎসাহিত করতে হবে। যুব সমাজকে সম্পৃক্ত করে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়নের মূল লক্ষ্য দক্ষ কর্মী তৈরি করা এবং পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, প্রায় ৯৪% মানুষ যারা দক্ষতা উন্নয়নে কোনো সহায়তা পায়নি তারাই অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি।
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন