প্রতিটি গ্রাম হোক, একটি পাঠাগার
রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির শতবছর উদ্যাপন উপলক্ষ্যে ২০১৩ সালে টাঙ্গাইল জেলার ভূঞাপুর উপজেলার অর্জুনা গ্রামে আমরা প্রতিষ্ঠা করেছিÑ হাজী ইসমাইল খাঁ কলেজ। রবীন্দ্রনাথের তপোবন দর্শন, গান্ধীজীর নঈ তালিম দর্শনের আলোকেই গঠিত হয়েছে আমাদের শিক্ষাদর্শন। রবীন্দ্রনাথের মতো আমরাও বিশ্বাস করি, শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করবে প্রকৃতির নিকট হতে। সেই জন্য কলেজ ক্যাম্পাসে লাগানো হয় ৭২ প্রজাতির ফলদ, ভেষজ, বনজ বৃক্ষ। শিক্ষার্থীদের বনিয়াদি শিক্ষা প্রদানের জন্য স্থাপন করা হয়েছে ৮টি কম্পিউটার সমৃদ্ধ আধুনিক কম্পিউটার ল্যাব। আছে সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এই কলেজ শুধু কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করবে না, অত্র এলাকার মানুষকে দক্ষ মানবসম্পদে উন্নত করার জন্যও কাজ করবে। আমাদের স্বপ্ন, জ্ঞানবিজ্ঞানের সকল শাখারই চর্চা হবে এখানে। ধীরে ধীরে এটি পরিণত হবে, একটি বিশ্ববিখ্যাত ইনিস্টিটিউটে।
সবকিছু উপেক্ষা করে যদি আপনি শুরু করেন, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারিÑ কাউকে না কাউকে আপনি আপনার পাশে পাবেন। যে বা যিনি আপনাকে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করবে, সহযোগিতা করবে। তখন আবার আপনি হবেন অনেকেরই ঈর্ষার বস্তু, নানাধরনের অপপ্রচার ছড়াবে তারা আপনার বিরুদ্ধ। আপনি বাইরে থেকে কাড়ি কাড়ি টাকা নিয়ে আসছেন, আপনি মেম্বার বা চেয়ারম্যান নির্বাচনে দাঁড়াবার মতলব করছেন। আপনার সদিচ্ছা, সৎ পরিকল্পনাকে ভ-ুল করবার জন্য স্থানীয় কিছু রাজনীতিবিদ ও প্রশাসনও বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে, ধৈর্য ধরবেন। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলরে’ নীতিতে চলে যাবেন। সফল আপনি হবেনই।
২০০৬ সালে অর্জুনা অন্বেষা পাঠাগার স্থাপনের মাধ্যমে শুরু হয় গ্রাম পাঠাগার আন্দোলনের কার্যক্রম। আজ প্রায় ১০ বছর পর গ্রাম পাঠাগার আন্দোলনের দর্শন বিশ্বাস করে এ রকম পাঠাগারের সংখ্যা ৪২টি। আরও শত শত পাঠাগারের সঙ্গে রয়েছে আমাদের যোগাযোগ। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে একটি কলেজে। ২০১৪ সাল থেকে শুরু হয়েছে তার পাঠদান কার্যক্রম। গ্রামীণ পর্যটন শিল্পবিকাশে অর্জুনাতে শুরু হয়েছে ‘গ্রামে ঘুরি’র কাজ। বিগত ৩ বছরে প্রায় ১৫০ জন পর্যটক ঘুরে গেছেন টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত গ্রাম অর্জুনায়। উপভোগ করেছেন যমুনা পাড়ের অর্জুনা গ্রামের সৌন্দর্য। যাত্রীদের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য নির্মিত হয়েছে যাত্রী ছাউনী। ২০০৬ সাল থেকে টাঙ্গাইলের অর্জুনা গ্রামে হয়ে আসছে বইমেলা। গ্রামবাসী এখন চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় থাকে কবে আসবে ফেব্রুয়ারি মাস, কবে শুরু হবে মেলা? এই বইমেলা যেন গ্রামবাসীর মিলনমেলা। যে মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে তারা এই সময়ই বাপের বাড়ি আসে, আর ছেলেরা যারা চাকরি করে তারা এই সময়টাতেই বাড়িতে আসে। ফলে মেলাটা যেন আরেকটা ঈদ উৎসব হয়ে ওঠে গ্রামবাসীর কাছে।
আমরা স্বপ্ন দেখি, গ্রামে গ্রামে পাঠাগার স্থাপনের মধ্য দিয়ে বিনে সুতায় একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে, বিপদ-আপদে একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়াতে, নিজেদের ইতিহাস-সংস্কৃতি রক্ষায় নিজেদের ভূমিকা রাখতে। তাই আমাদের পরিকল্পনা, ২০১৬ সালের মধ্যে প্রতিটি জেলার কোনো না কোনো গ্রামে, ২০২১ সালের মধ্যে প্রতিটি উপজেলার কোনো না কোনো গ্রামে আর ২০২৬ সালের মধ্যে প্রতিটি ইউনিয়নের কোনো না কোনো গ্রামে একটি করে পাঠাগার স্থাপিত হবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমরা বদ্ধপরিকর।
আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করছিÑ গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন কোনোক্রমেই পাঠক তৈরির আন্দোলন নয়। যদি পাঠক তৈরি হয়-ই সেটি তার বাড়তি পাওনা। এর আসল কাজ হলো, প্রথমে গ্রামের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা। সমস্যা সমাধানে কাজ করা। সকলকে নিয়ে স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে কম খরচে, সহজে বিকল্প উপায়ে অতিদ্রুত তার সমাধান করা। কোনোভাবেই সরকার বা অন্যকোনো সংগঠনের দিকে তাকিয়ে থাকা যাবে না। যেমন, দক্ষিণাঞ্চলে বন্যা বা জলোচ্ছ্বাসের কারণে মাঝে মাঝে বাঁধ ভেঙে লোনা পানি আবাদি জমিতে ঢুকে পড়ে। এতে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়। যদি দ্রুত বাঁধ মেরামত করা না হয় তবে প্রতিদিন জোয়ারের পানি প্রবেশ করে এবং জমির লবণাক্ততা বাড়িয়ে দেয়। ফলে জমির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হয়। কিন্তু এ সময়ই যদি একদল উদ্যোগী মানুষ একত্রিত হয়ে গ্রামের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকে নিয়ে বাঁধ মেরামতের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে তবে তা অতি সহজে স্বল্প সময়ে এবং স্বল্প শ্রমেই দ্রুত মেরামত করা সম্ভব, যা আমরা মাঝে মাঝে বিভিন্ন দৈনিকে সচিত্র প্রতিবেদন আকারে দেখতে পাই। এখন আমরা ওই স্বল্প অথচ সংঘবদ্ধ মানুষগুলোর নিরন্তর প্রচেষ্টাকেই আমরা নাম দিতে চাই ‘গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন’। কারণ ওই মানুষগুলোর কাছে পুরো গ্রামটাই একটা পাঠাগার। গ্রামের মানুষগুলো হলো, বই। আর কলম হলো, গ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদ, যা দিয়ে সে রচনা করতে পারে গীতাঞ্জলির মতো এক একটা গীতাঞ্চল। (শেষ)
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন