অফিস সময়ের অপব্যবহার
দেশের আদালতসহ সরকারি ও সায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহের অফিস সময় সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত, যদিও সরকারি ব্যাংকসমূহের অফিস সময় অভিন্ন নয়। এ অফিস সময়টি সরকারের নির্বাহী আদেশ দ্বারা নির্ধারিত। বেসরকারি ব্যাংকসহ অধিকাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস সময় সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা তবে; কিছু কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস সময় সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। দেশের সরকারি ও সায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা সপ্তাহে দুদিন ছুটি ভোগ করে থাকে, অপরদিকে প্রায় সকল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাপ্তাহিক ছুটি একদিন।
সরকারি ও সায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের পদস্থ কর্মচারীরা সার্বক্ষণিক গাড়ির সুবিধা পেয়ে থাকেন। তাদের সকলেই অফিসে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেন। অনেক কার্যালয়ের ক্ষেত্রে মধ্যম পর্যায়ের কর্মচারীদের অফিসে আনা-নেওয়ার জন্য মাইক্রোবাসের ব্যবস্থা আছে। নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারীদের ক্ষেত্রে সচরাচর দেখা যায়, স্টাফ বাসের মাধ্যমে আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। মধ্যম ও নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারীদের ৯০ শতাংশের অধিক নির্ধারিত সময়ে অফিসে উপস্থিত হয় তবে; অফিস ত্যাগের ক্ষেত্রে দেখা যায় এ ধরনের কর্মচারীরা অফিস সময় শেষ হওয়ার ২০-৩০ মিনিট আগে স্টাফ বাস ধরার অজুহাত দেখিয়ে অফিস ত্যাগ করে। পদস্থ কর্মচারীরা সার্বক্ষণিক গাড়ির সুবিধা পাওয়ার কারণে তাদের ক্ষেত্রে বিলম্বে অফিসে উপস্থিতির কোনো যৌক্তিক কারণ না থাকলেও তাদের অনেকে নিয়মিত নির্ধারিত সময়ের আধা হতে এক ঘণ্টা পর অফিসে উপস্থিত হন। অফিসে উপস্থিত পরবর্তী তারা যে অফিসের কাজে মনোনিবেশ করেন তা নয়। অনেককে দেখা যায়, সেদিনকার খবরের কাগজ হাতে নিয়ে আধা হতে এক ঘণ্টা সময় পার করে দেয়। আবার এমন অনেককে দেখা যায়, অফিসে এসে তড়িঘড়ি ওয়াশরুমে ঢুকে ১৫-২০ মিনিট পর অনেকটা অবসন্নভাবে বেরিয়ে এসে নিজ আসনে বসেন। অবসন্নভাবে বেরিয়ে আসার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার বড় কাজটি বাড়িতে সমাধা করে আসা হয়নি। এরপর রয়েছে অফিস সময়ে নিজ কক্ষে আগত অভ্যাগতদের নিয়ে চা পানে খোশগল্পে মত্ত হওয়া। এ ধরনের কর্মচারীরা প্রতিদিন অফিস সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এভাবে অপব্যয় করেন।
বর্তমানে পৃথিবীর সকল উন্নত দেশে সকল ধরনের সরকারি ও বেসরকারি অফিসে কোনো পর্যায়ের কর্মচারীর কক্ষে অভ্যাগতদের উপবেশনের জন্য কোনো চেয়ারের ব্যবস্থা রাখা হয় না। এ সকল দেশের সব অফিসের নির্ধারিত স্থানে টি-কর্নার রয়েছে। যেকোনো অফিসে যেকোনো অভ্যাগত আসলে তিনি অফিসের গেস্ট রুমে অপেক্ষা করেন এবং সেখানেই আলাপ করে কার্য সমাধা করেন। সংশ্লিষ্ট অফিসের কোনো কর্মচারী তাকে চা বা কফি দ্বারা আপ্যায়ন করতে চাইলে টি-কর্নারে নিয়ে যান এবং কোনো অবস্থায়ই অভ্যাগতদের কাউকে অফিসের কোনো কর্মচারীর কক্ষে নেওয়া হয় না। আর এ কারণে কোনো কর্মচারীর কক্ষে টেবিলের সামনে অভ্যাগতদের উপবেশনের জন্য চেয়ার রাখা হয় না।
দেশে সকল পর্যায়ের কর্মচারীরাই অফিস কক্ষে নিজ চেয়ারে উপবেশন করে নিত্যদিনের খবরের কাগজ পড়ে ও চা পানে অযথা অফিস সময়ের অপব্যবহার করেন। অফিসের যে নির্ধারিত সময় এ সময়টুকুতে সকল পর্যায়ের কর্মচারীদের নিজ নিজ অফিসের কার্য সম্পাদনে ব্যস্ত থাকার কথা কিন্তু দেশের কোনো সরকারি বা সায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে এটির সঠিক প্রতিপালন পরিলক্ষিত হয় না।
অফিস সময়ে যেকোনো পর্যায়ের কর্মচারীর অফিসের কাজ ব্যতীত অফিসের বাইরে যাওয়ার কথা নয় কিন্তু অনেক কর্মচারীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, অফিসে আসার পর ব্যক্তিগত কাজে প্রায় প্রতিদিনই অফিস হতে বাইরে যান এবং অফিস সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য সময় বাইরে অবস্থান করে অফিস শেষ হওয়ার আগমুহূর্তে অফিসে উপস্থিত হয়ে তড়িঘড়ি অফিস ত্যাগের প্রস্তুতি নেন।
দেশের সরকারি ও সায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহে নামাজ ও মধ্যাহ্নের আহারের জন্য আধা-ঘণ্টার কর্মবিরতি নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে নামাজ ও মধ্যাহ্নের আহার সম্পন্ন না হওয়ায় মধ্যাহ্ন বিরতির ব্যাপ্তি এক ঘণ্টা বা এর অধিক সময় পর্যন্ত গড়ায়।
আগেকার অফিস পিয়ন পদধারীদের অবমূল্যায়ন নিরসনে তাদের পদবির নামকরণ অফিস সহায়ক করা হলেও এর দ্বারা তাদের কর্মপরিধির পরিবর্তন হয়নি। তারা আগেকার মতো এখনও অফিস সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পদস্থ ও তাদের অভ্যাগতদের জন্য চা বানানো, আহার পরিবেশন, চায়ের কাপ, প্লেট, চামচ ধোয়া মোছায় ব্যয় করেন। আবার অনেক পদস্থ এদের দিয়ে বাজার করানোসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত কাজ করান অথচ এগুলোর কোনোটিই তাদের নির্ধারিত সরকারি দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত নয়। পৃথিবীর কোনো উন্নত রাষ্ট্রে আমাদের দেশের ন্যায় পিয়ন তথা অফিস সহায়কের পদ নেই। দেশে এসব পদধারীরা অফিসের কাজে যতটুকু না সময় ব্যয় করেন তার চেয়ে অধিক সময় ব্যয় করেন পদস্থ ও মধ্যম পর্যায়ের কর্মচারীদের বিভিন্নধর্মী সেবায়। এ ধরনের সেবা আইন দ্বারা অনুমোদিত নয় এবং এ ধরনের সেবা গ্রহণ করে পদস্থ ও মধ্যম পর্যায়ের কর্মচারীরা প্রকারান্তরে অফিস সময় অপব্যহারের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন।
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন