ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন
ক্যাম্বোডিয়ায় গিয়ে যাদুঘরে পলপট বাহিনীর গণহত্যা আর নৃশংস নির্যাতনের নিদর্শন দেখে আমি কেঁদেছি। নমপেন শহরের ত্যুল সেøঙ্গ জেনোসাইড মিউজিয়াম, একসময় উচ্চ বিদ্যালয় ছিল। ত্যুল সেøঙ্গের অর্থ হলোÑ ‘বিষাক্ত বৃক্ষের পাহাড়’। ১৯৭৫-এর আগস্ট মাসে এই বিদ্যালয়ের পাঁচটা ভবনকে তৎকালীন পলপটের নেতৃত্বাধীন খেমাররুজ সরকার উচ্চ নিরাপত্তাসম্পন্ন কারাগারে পরিণত করে নাম দিয়েছিল ‘সিক্যুরিটি প্রিজন ২১, সংক্ষেপে এস-২১’। প্রতিটা ভবন বিদ্যুতের তার দিয়ে ঘেরা থাকত, আর প্রতিটা শ্রেণিকক্ষ ছিল কারাগারের আর নির্যাতনের একেকটা কক্ষ। কক্ষের জানালাগুলো লোহার মোটা পাত দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, সঙ্গে বিদ্যুতায়িত তার যাতে কোনো বন্দি পালিয়ে না যেতে পারে। কারাগারে ভয়াবহ নির্যাতনের ইতিহাস বর্তমান যাদুঘরে সযতনে লিখে রাখা আছে। সারা ক্যাম্বোডিয়া জুড়ে এরকম আরও কমপক্ষে ১৫০টি কারাগার ছিল যেখানে হাজার হাজার মানুষকে বন্দি করে রাখা হতো, অমানবিকভাবে নির্যাতন করা হতো। কত হাজার মানুষকে যে নির্যাতন করতে করতে হত্যা করা হয়েছে, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছেই নেই। তবু প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পলপট সরকারের নির্যাতনের কাহিনী জেনে মানুষ বেদনায় আদ্র হবে, ঘৃণায় কঠোর হবে। লেখার বাইরেও আমার দোভাষী কিভুর মুখে নিষ্ঠুরতার বর্ণনা শুনে আমার বিকেলটা বিবর্ণ হয়ে উঠেছিল।
দক্ষিণ আফ্রিকার উমতাতা শহরে নেলসন ম্যান্ডেলা যাদুঘরে গিয়ে ম্যান্ডেলার সংগ্রামী জীবন আর দীর্ঘ কারাবাসের ইতিহাস জেনে আমি বিস্মিত হয়েছি। নেলসন ম্যান্ডেলার গ্রামের বাড়ির পাশের উমতাতা শহরের ওয়াল্টার সিসুলু বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পড়াতে যেতাম। একবার ছাত্রদের সঙ্গে শহরের বুকে অবস্থিত নেলসন ম্যান্ডেলা যাদুঘরে গিয়েছিলাম। যাদুঘরে ম্যান্ডেলার সংগ্রামী জীবন, দীর্ঘ কারাবাস, কারাগারে ব্যবহৃত জিনিষপত্র, তার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে এই যাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে। কী এক অসাধারণ সংগ্রামী জীবন ছিল তার।
অথচ ক্যাম্বোডিয়ার চেয়েও অনেক নির্মম গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে আমাদের নিজের দেশ, বাংলাদেশে। আমরা কি তা জানি? আমরা কি সেই কথা ভেবে কেঁদেছি কখনও? শুনেছি বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে সারাদেশব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা একাত্তরের বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। সারাদেশব্যাপী আমাদেরও কিছু জেনোসাইড মিউজিয়াম হওয়া উচিত। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম জানবে কত বিসর্জনের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতাকে অর্জন করা।
অথচ ম্যান্ডেলা কিংবা তারচেয়েও অধিক সংগ্রামী, কারানির্যাতিত এক নেতা আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। আমরা কি কখনও উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি, আমাদের বঙ্গবন্ধুর মতো একজন বিশ্বমাপের নেতা আছেন, যাকে নিয়ে বুক চিতিয়ে আমরা অহংকার করতে পারি। আমরা আসলে বঙ্গবন্ধুকে কতটুকু চিনি, কতটাই বা জানি? তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের কতটুকুই বা আমরা আবিষ্কার করেছি?
আমরা কি আসলে জানি আমাদের কি আছে আর কি নেই?
লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী কবি ও কলামিস্ট
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন