আড্ডার পাদ্রি শহীদ কাদরী
আগস্ট বাঙালির শোকের মাস। কবিহন্তারক মাস। এ মাসেই বঙ্গ হারিয়েছে তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান, রাজনীতির অনন্য কবি বঙ্গবন্ধুকে। এ মাসেই উড়াল দিলেন কবি শহীদ কাদরী! এতে অগাস্ট-এর শোকের রঙ আরও প্রগাঢ় হলো। আরও শোকমাহাত্ম্য পেলো। কিন্তু তাতে শহীদ কাদরীর কিছুই যায় আসে না। তিনি জীবদ্দশাতেই জীবনকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। প্রবাসের মাধ্যমে প্রতিকী মৃত্যুর স্বাদ নিয়েছিলেন। তাই নিউইয়র্কে শরীরী মৃত্যুর পরপরই আমরা তাকে নতুন করে জন্ম নিতে দেখলাম। ভার্চুয়াল জগত হয়ে পড়ল শহীদ কাদরীময়; এই ঈর্ষণীয় স্মরণকা- কেবল কিংবদন্তি কিম্পুরুষ ‘কিং-কবিদের’ কর্ম আর জীবনগুণেই হয়।
বাংলাদেশের সব বড় বড় কবি-সাহিত্যিকেরা শহীদ কাদরীর বন্ধু। আমরা তার কবিবন্ধুদের লেখার মাধ্যমেই তাকে পেয়েছি। সেসব লেখায় এই আজব কবিকেই আপাদমস্তক কবিতা মনে হয়। ২০১৩ সালে আমি অনেকগুলো বই উপহার পেয়েছিলাম। এর মধ্যে সবচেয়ে মজার বইটি দিয়েছিলেন কুমিল্লার নোমান ভাই। কবি বেলাল চৌধুরীর ‘নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায়।’ বইটি সম্বন্ধে ফ্ল্যাপে লেখা, এই বই বেলাল চৌধুরীর ধমনীর রক্তনালীর ইতিহাস। বইটি নানা কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাভাষী সবারই পড়া উচিত। আত্মজীবনীমূলক এ বইয়ের ঢাকা পর্বে ‘আমাদের যৌবরাজ্যের সৌন্দর্যখনি বিউটি বোর্ডিং’ শিরোনামে একটি লেখা আছে। সেখানে ‘আড্ডাবাজ এক কবি’ উপ-শিরোনামে তিনি বন্ধু শহীদ কাদরী সম্বন্ধে স্মৃতিচারণ করেছেন। আমিও কবি বেলাল চৌধুরীর মাধ্যমেই পাঠককে শহীদ কাদরীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। এবং একইসঙ্গে ‘আদি ও অকৃত্রিম একক ও স্বরাট বিউটিয়ান’-এর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি।
‘যারা শহীদ কাদরীকে চেনে তারা আমার সঙ্গে সায় দেবেন কি না জানি না, আড্ডার সমার্থক শব্দের একটি হচ্ছে শহীদ কাদরী। শুধু আড্ডাবাজই নয়, আড্ডাবাজ শব্দটি রাবারের মতো রাজাধিরাজ পর্যন্ত টেনে নিতেও কষ্ট হবার কথা নয়।’
‘যেকোনো বিষয়ে প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে যেতে শহীদের ক্ষমতা ছিল এককথায় দ্বিতীয়রহিত। ব্যক্তিগতভাবে শহীদের সঙ্গে আমার চাক্ষুষ পরিচয় হয়েছিল প্রায় দুযুগেরও অধিককাল আগে। আধুনিক শহুরে এবং মুক্তমনের মানুষ বলতে যা বোঝায়, শহীদ ছিল সেন্ট পার্সেন্ট ঠিক তাই। কেন জানি না বা বলতে পারব না, শহরের বাইরের কোনো পরিবেশে শহীদকে কেমন যেন ঠিক মানাত না। আমি অনেকবার মিলিয়ে দেখতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছি। শহীদের ভরাট কণ্ঠস্বর, সুচারু বাগবৈদগ্ধ্য, প্রখর উপস্থিতবুদ্ধি ও রসবোধ, বিদ্যুৎ চমকের মতো তীব্র শ্লেষ, অব্যর্থ লক্ষ্যভেদী ও ক্ষুরধার বাক্যবাণ সহজেই কাউকে ধরাশায়ী করার জন্য ছিল যথেষ্ট।’
‘শহীদ মানেই ঢাকার অগুনতি ক্যাফে, রেস্তোরাঁ, চায়ের দোকানে অখ- ও নির্ভেজাল আড্ডা আর আড্ডা, সদলবলে অ্যাসফল্টের রাস্তা, অলিগলি ভেঙে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ানো দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। কি অমাবস্যা, কি জ্যোৎস্নালোকিত রাত, শহীদের কাছে সবই সমান। বিশেষ করে রাত যত গভীরতর হতো, ততই যেন আরও জমজমাট আর চাঙা হয়ে উঠত সবকিছু।’
‘কবি বলে শহীদ যে শুধু কবিদের সঙ্গেই আড্ডা দিত মোটেই তা নয়। শহীদের আড্ডার পরিম-লে বহু বিচিত্র চরিত্রের সমাবেশ ঘটত। তবে কবি ও কবিতা যে শহীদের কাছে পরম উপাদেয় ও মুখরোচক প্রসঙ্গ ছিল সে তো বলাই বাহুল্য। শহীদকে নিয়ে অজস্র চুটকি, বহু রসিকতা, অনেক কৌতুক প্রচলিত আছে বাজারে। সংখ্যার দিক থেকে সেগুলো এতই অপ্রতুল ও কৌতূহলোদ্দীপক যে, কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি। শহীদকে নিয়ে বহু গল্প তার বন্ধুদের মুখে মুখে ঘোরে, প্রায় নিত্য এবং প্রিয় প্রসঙ্গের মতো।’
‘শহীদ কাদরী সর্বতোভাবে একজন খাঁটি কবি। শহীদ এমন কবিদের দলে, যারা অত্যন্ত কম লেখেন কিন্তু তাদের প্রতিটি রচনাই সমানভাবে উল্লেখযোগ্য এবং পাঠকসমাজে আদৃত হয়। শহীদের কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে শহুরে মানুষ নাগরিক মানসের প্রতিচ্ছবি, তাদের সমস্যাজর্জরিত জটিল জীবন, ভাবাবেগ, আতঙ্ক, অনিশ্চয়তাবোধ, ক্রোধ, হিংসা, হতাশা, কৃত্রিমতা; কখনও বহিরাশ্রয়ী প্রতীকের গভীরতায়, কখনও তীক্ষ্ম উপমায় রূপকল্পে। বিংশ শতাব্দির রুদ্ধশ্বাস নাগরিক জীবনের নাটকীয় স্পন্দনময়তাকে শহীদ তার কবিতার সর্বাঙ্গে বিস্ময়করভাবে নিপুণতার সঙ্গে সংহত করে তোলেন। তার প্রতিটি কবিতাই বুদ্ধিদীপ্ত ও ঝকঝকে। তার ভাষা অত্যন্ত ঋজু সংকেতময় এবং তীব্র গতিসম্পন্ন। ত্রিশোত্তর বাংলা কবিতার নিরক্ত ধমনীতে শহীদ নতুন রক্তোচ্ছ্বাস এনে দিয়েছেন। স্বোপার্জিত মুদ্রা অঙ্কিত করেছেন তার কাব্যপ্রতিমায়। প্রেমের কবিতায় শহীদ একটি ব্যাপক প্রেমানুভূতিকে পরতে পরতে মেলে ধরে তার মধ্যে সঞ্চারিত করেন শাশ্বত রহস্যের আর্তি আকুতি।’
‘কিন্তু এই যে এতকিছু শহীদকে নিয়ে, অর্থাৎ তুখোড় আড্ডাবাজ শহীদ, বাকপটু শহীদ, বিশালবপু শহীদ, প-িত শহীদ, তার সব পরিচয়কে ছাপিয়ে শহীদের ভিতর যে এক সরল, অভিমানী ও অমলিন শিশু এবং সর্বোপরি একজন বড় মাপের কবি লুকিয়ে রয়েছেÑ তার মধ্যে কিন্তু কোথাও একরত্তি খাদ মেশানো নেই।’
‘তবে শহীদ কাদরী যে ঢাকায় নেই বা শহীদবিহীন ঢাকা শহরÑ এটা দেখছি শহীদের শত্রুমিত্র সবার কাছেই সমান আক্ষেপ ও বেদনার। নানা সময়ে বরং বিভিন্ন প্রসঙ্গে অনেককেই বলতে শুনেছি, ‘আহা! শহীদ যদি থাকত এখন, বেশ হতো।’ এই একটি বাক্য দিয়েই বোঝা যায়, শহীদের মিত্র এবং শত্রুরা কতটা ‘মিস’ করছে শহীদকে।’
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন