কাবা ঘরের মাহাত্ম্য ও নির্মাণ ইতিহাস
মাওলানা মুতীউর রহমান
মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘নিশ্চয় সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্য স্থাপন করা হয়েছে সেটি যা মক্কা নগরীতে (অবস্থিত) যা বরকতময় ও বিশ্ববাসীর জন্য হেদায়াত। সুরা আল ইমরান: ৯৬
এ আয়াতটিতে কাবা ঘরের তিনটি মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। এক. এটি পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর (অর্থাৎ প্রকৃত উপাসনালয় সমূহের সর্বপ্রথম উপাসনালয়)। দুই. এটি বরকতময় ঘর। তিন. বিশ্ববাসীর জন্য হেদায়াত ও পথপ্রদর্শনের মাধ্যম।
‘কাবা ঘর পৃথিবীর সর্বপ্রথম ঘর’ এর দুটি অর্থ হতে পারে। এক. ঘর বলতে ধরাপৃষ্ঠে সর্বপ্রথমে এটিই নির্মিত হয়েছে। ইতিপূর্বে ইবাদতখানা বা উপাসনালয় হিসেবেও কোন ঘর নির্মিত হয়নি মানুষের বাসস্থান হিসাবেও কোন ঘর নির্মিত হয়নি। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা., মুজাহিদ, কাতাদা প্রমুখ থেকে এরূপ বর্ণিত রয়েছে। দুই. মানুষের বাসগৃহ ইতিপূর্বেও নির্মিত হয়েছে বটে কিন্তু ইবাদতখানা বা উপাসনালয়সমূহের মধ্যে এটিই সর্বপ্রথম নির্মিত হয়েছে। এটিই হজরত আলী রা. হতে বর্ণিত।
আল্লাহ তাআলার নির্দেশে হজরত আদম আ. সর্বপ্রথম এ ঘর নির্মাণ করেন। তারপর হজরত নূহ আ. এর যুগে প্লাবনে ঘরটি বিধ্বস্থ হয়ে গেলে হজরত ইব্রাহীম আ. এটি পুনঃনির্মাণ করেন। এরপর কোন কারণে বিধ্বস্থ হলে জুরহুম গোত্রের লোকেরা পুনঃনির্মাণ করে। এরপর পঞ্চমবার বিধ্বস্থ হলে কুরাইশরা নির্মাণ করে। এ নির্মাণকাজে খোদ রাসুলুল্লাহ সা.ও অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং নিজ হাতে হাজারে আসওয়াদ স্থাপন করেন যার ঘটনা সুপ্রসিদ্ধ। কিন্তু এবার নির্মাণকালে কুরাইশরা কাবাঘরে কিছুটা পরিবর্তন ঘটায়।
পরিবর্তনগুলো হলো, এক. হজরত ইব্রাহীম আ. যে বুনিয়াদের উপর ঘর নির্মাণ করেছিলেন তা থেকে কিছু অংশ বাদ দিয়ে নির্মাণ করে যা হাতিম নামে অভিহিত। দুই. কাবা ঘরের দরজা ছিল দুইটি। একটি পূর্বমুখী আরেকটি পশ্চিমমুখী। তারা পূর্বমুখী দরজাটি বহাল রাখে আর পশ্চিমমুখীটি বন্ধ করে দেয়। তিন. কাবা ঘরের দরজা ভূমি থেকে বেশ উঁচু করে ফেলে যেন যে কেউ অনায়াসে ঘরে প্রবেশ করতে না পারে। বরং যাকে তারা অনুমতি ও সুযোগ দিবে সেই প্রবেশ করতে পারে।
রাসুলুল্লাহ সা. একদিন আয়েশা সিদ্দীকা রা. কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, আয়েশা! আমার মনে চায় কাবা ঘরের বর্তমান নির্মাণ কাঠামো ভেঙ্গে দিয়ে হজরত ইব্রাহীম আ. নির্মিত কাঠামো অনুযায়ী নির্মাণ করি। কিন্তু নওমুসলিম কুরাইশদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা বোধ করছি তাই আপন অবস্থায় রেখে দিচ্ছি। এ কথা বলার পর রাসুলুল্লাহ সা. আর বেশি দিন ইহজগতে প্রাণাবদ্ধ থাকেননি।
কিন্তু হজরত আয়েশা রা. এর ভাগ্নে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রা. আপন খালা হজরত আয়েশা রা. থেকে রাসুলুল্লাহ সা. এর এ উক্তিটি শুনেছিলেন। তাই তিনি যখন মক্কার খলিফা নিযুক্ত হন তখন তিনি কাবা ঘরের এ কাঠামো বিলুপ্ত করে রাসুলুল্লাহ সা. এর বাসনা অনুযায়ী এবং হজরত ইব্রাহীম আ. এর কাঠামো অনুযায়ী নির্মাণ করেন। এতে হাতিমকে কাবা ঘরের অন্তর্ভুক্ত করেন, পশ্চিমমুখী আরেকটি দরজা খুলেন এবং দরজা নিচু করে দেন।
কিন্তু আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রা. এর হুকুমত বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। হাজ্জাজ বিন ইউসুফ ও তৎকালীন আমীর আব্দুল মালিক ইবেন মারওয়ান মনে করল বাইতুল্লাহ রাসুলুল্লাহ সা. এর যুগে যে কাঠামোতে ছিল সে অনুযায়ী থাকা চাই। অব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের এতে যে পরিবর্তন ঘটিয়েছেন তা ঠিক করে নাই। এ বলে পুনরায় খানায়ে কাবাকে পূর্বের অবস্থায় নিয়ে যায়। অদ্যাবধি হাজ্জাজ বিন ইউসুফ নির্মিত কাঠামোই অক্ষুণœ রয়েছে অবশ্য সময়-সময় সাময়িক মেরামত অবশ্যই সাধিত হচ্ছে।