কুরবানির বিধান ও ফজিলত
মুফতি আমিনুল ইসলাম
কুরবানি করা ওয়াজিব। ইমাম আওযায়ী, ইমাম লাইস, ইমাম আবু হানীফা ইমাম মালেক ইমাম আহমদ ও ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. প্রমুখের মত এটাই। (কিতাবুল আসার ২/৭৫৯, মুহাম্মদ বিন উসাইমিন কৃত আহকামুল উযহিয়্যা; পৃষ্ঠা ২৬)
আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছেন, তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামাজ আদায় কর ও পশু কুরবানি কর। সুরা কাউসার: ২
হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের ধারে না আসে। মুসনাদে আহমদ: ৮২৫৬
রাসুলে কারিম সা. বলেছেন, হে মানব সকল! প্রত্যেক পরিবারের দায়িত্ব হলো প্রতিবছর কুরবানি দেয়া। সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩১২৫
এই আয়াত ও হাদিস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, কুরবানি করা ওয়াজিব।
কুরবানি যাদের উপর ওয়াজিব
যার উপর সদকা ফিতর (ফিতরা) আদায় করা ওয়াজিব, তার উপর কুরবানি করাও ওয়াজিব। অর্থাৎ কুরবানির তিন দিনের মধ্যে (১০ যিলহজ্জ ফজর থেকে ১২ যিলহজ্জ সন্ধ্যা পর্যন্ত) যদি কোন মুসলমান আকেল, বালেগ ও মুকীম ব্যক্তির নিকট প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, ঘর-বাড়ি ও আসবাবপত্রের অতিরিক্ত সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য, কিংবা সমমূল্যের টাকা বা যে কোনো সম্পদ থাকে, তবে তার উপর কুরবানি ওয়াজিব। কুরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য এ মাল-সম্পদ এক বৎসর কাল স্থায়ী হওয়া শর্ত নয়। এ পরিমাণ মাল-ধন কুরবানির দিনসমূহে থাকলেই কুরবানি ওয়াজিব হয়ে যাবে। তবে যাদের উপর কুরবানি ওয়াজিব নয়, তারা যদি (সঙ্গতি থাকলে) কুরবানি করে, তারাও অনেক সওয়াবের অধিকারী হবে। সুনানে ইবনে মাজাহ: ৩১২৩, আদ্দুররুল মুখতার ২/২৩১, ৯/৪৫৭, হিদায়া ১/২৩২)
কুরবানির পশু কেমন হবে?
গরু, মহিষ, উট, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানি করা যায়। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা এক বছরের। গরু, মহিষ দুই বছরের এবং উট পাঁচ বছরের হওয়া উচিত। কিন্তু ভেড়া ও দুম্বা যদি এমন হৃষ্ট পুষ্ট হয় যে, ছয় মাসেরটা দেখতে এক বছরের দেখায়, তবে এতেও কুরবানি হয়ে যাবে। সুরা হজ্জ: ৩৪, সহিহ মুসলিম: ৫১৯৪, ৫১৯৭, সুনানে তিরমিজি: ১৪৯৯, ফাতাওয়া আলমগীরী ৫/২৯৭, ফাতাওয়া শামী ৯/৪৬৫-৪৬৬
মাসআলা: কুরবানির পশু মোটা-তাজা, হৃষ্ট-পুষ্ট, সুদর্শন ও দোষমুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। খাসীকৃত পশুর কুরবানি উত্তম। ভেড়া থেকে দুম্বা কুরবানি উত্তম। খাসী থেকে বকরির কুরবানি উত্তম। এরূপ উট থেকে উটনী এবং ষাঁড় থেকে গাভী কুরবানি উত্তম। মুসনাদে আহমদ: ৯৭৩৯, ২৩৯১১, আদ্দুররুল মুখতার ৯/৪৬৬-৪৬৭
মাসআলা: কুরবানির পশু গর্ভবতী বলে জানা গেলেও তার দ্বারা কুরবানি জায়েয। তবে গর্ভে বাচ্চা জীবিত পেলে সেটাকেও আল্লাহর নামে যবেহ করে দিতে হবে এবং শরীকী কুরবানি হলে এটাকেও প্রত্যেকের অংশ হিসেবে পৃথক ভাগ করে দিতে হবে। কেউ ইচ্ছা করলে এর গোশত খেতে পারে। কিন্তু না খেলে কোন দোষ হবে না। ফাতাওয়া শামী ৯/৫৩৪, আযীযুল ফাতাওয়া ২/১৮২; ফাতাওয়া আলমগীরী ৫/২৮৯
মাসআলা: যদি বড় জানোয়ারের মধ্যে কারো অংশ সাত ভাগের এক ভাগের চেয়ে কম হয়, তাহলে একজনেরও কুরবানি আদায় হবে না। সহীহ মুসলিম: ১৩১৮, আদ্দুররুল মুখতার ৯/৪৫৭
মাসআলা: বকরী যতই মোটা তাজা হোক না কেন, তার জন্য এক বছর পূর্ণ হওয়া জরুরী। এক বছরের একদিন কম হলে কুরবানি জায়েয হবে না। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ৫১৯৪, রদ্দুল মুহতার ৯/৪৬৬)
মাসআলা: খরিদকৃত কুরবানির জানোয়ার দ্বারা নিজে উপকৃত হওয়া মাকরূহ। চাই সে ধনী হোক বা গরিব হোক। সুতরাং কুরবানির জন্য জানোয়ার ক্রয় করার পর যদি বাচ্চা হয় অথবা যবেহ করার পর যদি পেটে জীবিত বাচ্চা পাওয়া যায় তবে ঐ বাচ্চাটিও কুরবানি করে দিতে হবে। তবে বাচ্চা কুরবানি না করে জীবিত দান করে দেয়া জায়েয আছে। এমনিভাবে কুরবানির নিয়তে খরিদকৃত জানোয়ারের দুধও নিজে পান করবে না। গরিবদের মধ্যে দান করে দিবে। মুসনাদে আহমদ; ১৬২৫৫, ফাতাওয়া আলমগীরী ৫/৩০০-৩০১, ফাতাওয়া শামী ৯/৪৬৭
মাসআলা: কুরবানির পশু হারিয়ে যাওয়ার পর আরেকটি ক্রয় করা হলো। অতঃপর হারিয়ে যাওয়া পশুটি পুনরায় পাওয়া গেল। তাহলে ধনাঢ্য ব্যক্তির জন্য দুটির যে কোন একটি কুরবানি করা ওয়াজিব। পক্ষান্তরে সে ব্যক্তি যদি গরীব হয়, তাহলে তার উপর দুটি পশুই কুরবানি করা ওয়াজিব। উল্লেখ্য, ধনী ব্যক্তি যদি প্রথমে ক্রয়কৃত পশুটি কুরবানি না করে দ্বিতীয়টি করে এবং প্রথমটির চেয়ে দ্বিতীয়টির ক্রয় মূল্য কম হয়, তাহলে প্রথমটি ক্রয় করতে দ্বিতীয়টির চেয়ে যে পরিমাণ টাকা অতিরিক্ত লেগেছে, সে পরিমাণ টাকা সদকা করতে হবে। সুনানে বাইহাকী কুবরা; হা.নং ১৯৬৭১, ফাতাওয়া শামী ৯/৪৭১
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট