ঈদুল আজহা : ধৈর্য ও পরীক্ষার ঈদ
অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম চৌধুরী
আরবি ‘কুরবুন’ থেকে কুরবানি শব্দের উৎপত্তি। কুরবিয়্যাত অর্থ হল নৈকট্য অর্থাৎ ত্যাগের মাধ্যমে নৈকট্য লাভ। হিজরি দিনপঞ্জি অনুসারে প্রতিবছর ১০ জিলহজ্ব পবিত্র ঈদুল-আযহা বা কুরবানির ঈদ উদ্যাপিত হয়। কুরবানি হলো মুসলিম উম্মাহর পিতা হজরত ইব্রাহিম আ. এর সুন্নত। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে তার প্রিয় বান্দা হজরত ইব্রাহিম আ. এর পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত।
ত্যাগ ও কুরবানির মহিমায় ভাস্বর পবিত্র ঈদ-উল আজহা প্রতিবছরই আসে। হজরত ইব্রাহিম আ. এর সুন্নত অনুসরণ করে আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রত্যাশায় আমরা দিবসটি পালন করি। দুনিয়ার সর্বত্র মুসলিম সমাজকে আর একবার স্মরণ করিয়ে দেয়, প্রায় চার হাজার বছর পূর্বে আল্লাহর প্রিয় নবী হজরত ইব্রাহিম আ. এর আত্মনিবেদনের এক মর্মস্পর্শী ঘটনা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল এ ত্যাগ এবং কুরবানির মহান ঐতিহ্য আজ মিলিয়ে যাচ্ছে খুশীর আমেজ আর আনুষ্ঠানিকতায়।
পরম করুণাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হজরত ইব্রাহিম আ. কে তাঁর প্রাণাধিক পুত্রের কুরবানির আদেশ প্রদান করলেন। আদিষ্ট হয়ে কুরবানির সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করলেন। হজরত ইব্রাহিম আ. প্রিয় পুত্র ইসমাইল আ. কে বললেন, হে বৎস, ‘আমি স্বপ্নে দেখলাম তোমাকে জবেহ করছি, এখন তুমি বল এতে তোমার অভিমত কী? পুত্র ইসমাইল আ. বললেন, আপনাকে যা হুকুম দেওয়া হয়েছে আপনি তাই করুন। আল্লাহ চাহেন তো আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের একজন হিসাবে পাবেন।’ সুরা-সাফফাত: ১০২
এভাবেই পুত্র ইসমাইল আ. মেনে নিলেন আল্লাহর আদেশ। নিজেকে সঁপে দিলেন ধারালো ছুরির নিচে। স্বয়ং আল্লাহর প্রতি তাঁর বান্দার প্রেম-ভালবাসা কত প্রগাঢ়, নির্ভেজাল, গভীর ও বিস্তীর্ণ তা পরীক্ষা করাই হচ্ছে এ নির্দেশের গুঢ় রহস্য। হজরত ইব্রাহিম আ. এই ঐতিহাসিক পরীক্ষায় সর্বোতভাবে উত্তীর্ণ হলেন। আল্লাহ তাঁর এই কুরবানিকে ‘জবিহুন আজিম’ অর্থাৎ সর্বোত্তম কুরবানি বলে অভিহিত করলেন। আল্লাহর কুদরাতে পুত্র ইসমাঈল আ. জবেহে রাজি হলেন। ইসমাঈল আ. এর স্থলে বেহেশত থেকে হজরত জিবরিল আ. এর আনা দুব্বা জবেহ হয়ে গেল। এটাকে কেয়ামত পর্যন্ত তামাম মানব জাতির জন্য চিরস্মরণীয় কুরবানির প্রতীক হিসেবে এবং মু’মিন বান্দার ত্যাগের অনুপম নিদর্শন হিসেবে নির্ধারণ করলেন। আল্লাহ প্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে হজরত ইব্রাহিম আ. ঘোষণা করলেন- ‘ইন্না সালাতি ওয়া নুসকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন’। সুরা-আনআম: ১৬২। অর্থাৎ নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছুই বিশ্ব প্রতিপালক আল্লাহর জন্য নিবেদিত। এভাবেই আল্লাহর প্রিয় বন্ধু (খলিলুল্লাহ) আল্লাহর কাছে পরিপূর্ণরূপে আত্মসমর্পন করলেন।
হজরত ইব্রাহিম আ., হজরত ইসমাঈল আ. এবং বিবি হাজেরার ত্যাগ ও কুরবানি যেমন- বিশ্ববাসীর জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তেমনি হজরত ইব্রাহিম আ. কে স্বয়ং আল্লাহ বিশ্ব ইমাম-এর মর্যাদা দান করলেন। আর ঘোষণা দিলেন, ‘আমি তোমাকে গোটা মানব জাতির ইমাম বানালাম।’ সুরা বাকারা: ১২৩
ত্যাগ ও কুরবানির উক্ত ঘটনা থেকে আমরা নিম্নোক্ত শিক্ষষীয় বিষয়সমূহ লাভ করতে পারি। ১. সত্যিকারভাবে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে হলে আল্লাহর আদেশ-নির্দেশ সর্বাবস্থায় মেনে চলতে হবে। এর মধ্যেই জীবনের সার্থকতা নিহিত। ২. আল্লাহর হুকুম পালন করতে গিয়ে কোনটা কঠিন এবং কোনটা সহজ তা দেখার সুযোগ নেই। ৩. আল্লাহর হুকুম মানার ক্ষেত্রে দুনিয়াবী কোন কামনা-বাসনা বা প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে না। সকল কিছুর উপর আল্লাহর দীনকেই স্থান দিতে হবে। ৪. ভোগের বিপরীতে ত্যাগেই কুরবানির অন্যতম প্রধান শিক্ষা। ৫. শুধু পশু কুরবানি নয়, পশুত্ব কুরবানিও কুরবানির অন্যতম শিক্ষা। পশুর রক্ত প্রবাহিত করার সাথে আমাদের ভেতরকার পাশবিকতাকে দমন করে সুকুমুর প্রবৃত্তিগুলোকে জাগিয়ে তুলতে পারলে আমাদের কুরবানি সার্থক হবে এবং সমাজে শান্তির সুবাতাস ছড়িয়ে পড়বে। অতএব, চলুন পবিত্র ঈদ-উল আজহার এদিনে আমরা সবাই আত্মশুদ্ধি ও ত্যাগের মহিমায় নিজের জীবন উদ্ভাসিত করি। মনের ভেতর লুকায়িত পশুবৃত্তি হনন করি। সবধরনের হিংস্রতা ও জিঘাংসা পরিহার করি। স্বাদেশ প্রেম আর মানবতায় হৃদয় প্রসাদ তৈরি করি, সেই সৌকর্য ম-িত পবিত্র কাবা মিনারের মতো।
লেখক: শিক্ষাবিদ