অস্ত্র রেখে বলে জঙ্গি ধরেছি পরে মারা হয় : খালেদা জিয়া
শাহানুজ্জামান টিটু: বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, অস্ত্র রেখে কিছু কিছু পুলিশ সদস্য বলে এরা জঙ্গি; এদের ধরেছি। কিছুদিন পর দেখা যায়, তাদের (জঙ্গি) গুলি করে মেরে ফেলা হয়। পদ্মা সেতু প্রকল্প আদৌ আলোর মুখ দেখবে না বলেও মন্তব্য করেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বিএনপির ৩৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সভায় খালেদা জিয়া এসব কথা বলেন। দীর্ঘ বক্তৃতায় খালেদা জিয়া সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক, ফারাক্কা বাঁধ, পানি চুক্তি, রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্র, জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ, সরকারের জঙ্গি দমন নীতি, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ প্রশাসন দলীয় করণ, ধর্মীয় মূল্যবোধ, মানবাধিকার, সকল ধর্মের মানুষের সহাবস্থানের বিষয়গুলো তুলে ধরেন।
খালেদা জিয়া বলেন, এ সরকার কথায় কথায় কিছুদিন পরপর জঙ্গির ধোয়া তুলে। অমুক জায়গায় এতজন জঙ্গি পাওয়া গেছে। তারপর জঙ্গিগুলোকে ধরে, সত্যিকার জঙ্গি কি না জানি না। কিছু লোক তাদের আগে থেকে ধরা থাকে। এগুলো না খেয়ে খেয়ে দীর্ঘদিন বন্দী করে রেখে তাদের দাঁড়ি, চুল এত বড় করে, বিদঘুটে চেহারা হয়ে যায়। তারপর তাদের জঙ্গি বলে সামনে নিয়ে আসে। আর কতগুলো পুলিশ আছে, অস্ত্রশস্ত্র সাজিয়ে বলে এরা জঙ্গি, হরকাতুল জেহাদ, এদের ধরেছি। তার কিছুদিন পর দেখা যায়, লোকগুলোকে ধরে, তাদের গুলি করে মেরে ফেলা হয়। কেন গুলি করে মেরে ফেলা হয়? দেশে আইন আছে, আদালত আছে, জিজ্ঞাসাবাদ করবে। এগুলো দুঃখজনক ঘটনা।
বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে কমিশন বাণিজ্যের জন্য ব্যয় বাড়ছে। আমাদের (বিএনপি) সরকারের আমলে এ সেতু নির্মাণে ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হলেও এখন তা ৩২ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। শেষ পর্যন্ত এ ব্যয় আরও বাড়বে। এ ব্যয় বাড়ছে কেন ? প্রশ্ন করেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, এ সেতুর নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধির পিছনে দুর্নীতিই কারণ। তারা যে খুব ভালো ভালো জিনিস দিচ্ছে তা নয়, এখানে কমিশনের ব্যাপার আছে। টাকা ঢুকছে মানুষের পকেটে। দুর্নীতির টাকা দেশে থাকলেও ভালো হতো। কিন্তু এ টাকা চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে।
খালেদা জিয়া বলেন, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদে যে সংবাদ সম্মেলন করেছিলাম তার অনেক সমালোচনা করেছে সরকার। তবে কোনো পয়েন্টের সদুত্তর তারা দিতে পারেনি। তিনি বলেন, সুন্দরবনের পাশে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়া উচিত নয়, অনেক ক্ষতি হবে। সুন্দরবন শেষ হয়ে যাবে। পৃথিবীর অনেক কম দেশের এমন বন রয়েছে। অনেক দেশে এত সুন্দরবন আবার নেইও।
বিএনপি নেত্রী বলেন, আমি কখনো বলিনি বিদুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হবে। যে জায়গায় ক্ষতি হয়, সেখানে না করার কথা বলেছি। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পরিবেশ নিয়ে অনেক কনসার্ন (উদ্বিগ্ন), তাই তিনটি সংস্থা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য টাকা দেয়নি। বাংলাদেশে এর চেয়েও খারাপ প্রজেক্ট নিয়ে আসা হচ্ছে। লাভ হলে ভাগ হবে, লোকসান হলে আমাদের উপর পড়বে। এটা কেমন করে হয়? এ সরকার দেশের স্বার্থবিরোধী, জনগণের বিরোধী বলে মন্তব্য করেন বিএনপি প্রধান।
দেশে আইনের শাসন নেই দাবি করে খালেদা জিয়া বলেন, আইন-শাসন সবার জন্য সমান নয়। আওয়ামী লীগ হলে একরকম, বিএনপি, অন্য পার্টি বা সাধারণ মানুষ হলে আরেক রকম। আওয়ামী লীগের লোকেরা অপরাধ করলে ও গুম, খুন, নারী নির্যাতন, লুটপাট এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মারধর করলেও বিচার করা হয় না। ন্যায় বিচার বলে কিছু নেই। যেখানে ন্যায়বিচার থাকে না, গণতন্ত্র থাকে না সেখানে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে।
যশোরে উদীচী, পল্টনে সিপিবির জনসভা, রমনার বটমূলে, গোপালগঞ্জে বোমা হামলার ঘটনার উল্লেখ করে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ওই সময় কোনো অপরাধী, জঙ্গি ধরা পড়েনি। জেএমবি, হরকাতুল জিহাদের একটা লোককেও তারা ধরেনি। তিনি বলেন, বিএনপি যখন ক্ষমতায় আসল। আমাদের সময়ও যে বোমাবাজি করেনি, তা নয়। কিন্তু আমরা তাদের বড় বড় নেতাদের জীবিত অবস্থায় ধরেছি। জীবিত ধরার কারণ একটাই, তাদের কাছ থেকে সত্যিকার তথ্য বের করা।
দেশের সম্প্রতি বন্যা পরিস্থিতির জন্য ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের সমালোচনা করে খালেদা জিয়া বলেন, এর প্রতিবাদ করতে হবে। বন্ধু বলে এদের কিছু বলা যাবে না, তা হয় না। এ বিষয়ে প্রতিবাদ করতে হবে। আলোচনা হতে হবে। একজন বন্ধু আরেক বন্ধু সমমর্যদার ভিত্তিতে সহায়তা করবে। তারা যদি মনে করে, তাদের মাথা উঁচু থাকবে আর আমাদের নিচু থাকবে; সেটি বন্ধুত্ব হয় না। নিজেদের প্রাপ্যতা আদায় করে নেওয়া উচিত। এ সময় ফারাক্কা বাঁধের কারণে ভারতের কঠোর সমালোচনা করেন বিএনপি নেত্রী।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশ ও জনগণের স্বার্থবিরোধী কাজ করছে অভিযোগ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। তিনি বলেন, যত চুক্তি দেখি সেগুলোর কোনোটাই দেশের স্বার্থে নয়। সমস্ত কিছু করা হচ্ছে, দেশের স্বার্থবিরোধী, জনগণের বিরোধী। কি সেই চুক্তি তা সবাই জানে না, আমরাও জানি না।
খালেদা জিয়া বলেন, জিয়াউর রহমান দায়িত্ব পাওয়ার পর সঠিক পরিকল্পনা করে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছেন। তিনি সবার সঙ্গে মিলেছেন, কথা বলেছেন, তিনি সবাইকে রাজনীতি করার সুযোগ দিলেন। জিয়াউর রহমান অল্প কয়েক বছরে দেশের চেহারা পাল্টে দিয়েছিলেন। তখন উৎপাদন অনেক বেড়েছিল। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। তিনি ৪০ বছর আগে যে পরিকল্পনা করেছিলেন তা এখনো প্রযোজ্য।
তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চেয়েছেন। যুদ্ধ করে, রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন, সে দেশের মানুষ সব সময় মাথা উঁচু করে থাকবে। কারও কাছে মাথা নিচু করবে না। সেভাবেই তিনি তার কাজ করেছেন।
খালেদা জিয়া বলেন, আমরাও তারই ধারাবাহিকতায় বিশ্বাস করি। সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক, কারও কাছে মাথা নিচু করে চুপিসারে কাউকে কিছু দিয়ে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করিনি, করবও না। সম্পাদনা: পরাগ মাঝি