লন্ডনে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সভায় সরকারের সমালোচনা
নাশরাত আর্শিয়ানা চৌধুরী: বিএনপির ৩৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে গত বুধবার পূর্ব লন্ডনের দ্য রয়েল রিজেন্সি অডিটরিয়ামে যুক্তরাজ্য বিএনপি আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পদক কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, ফারাক্কার বাঁধ খুলে দেওয়ায় উত্তরাঞ্চলে বন্যা, আওয়ামী লীগের জঙ্গি কানেকশনসহ দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির উপর বক্তব্য রাখেন। বক্তারা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সাহস ও সতর্কতার সঙ্গে প্রস্তুতি নিতে দলের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান।
তারা বলেন, প্রতিদিন ঘর থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে মানুষকে গুম করে ফেলা হচ্ছে অথচ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে তারা কিছুই জানে না। আগামী দিনে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হলে এখন যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বে রয়েছেন তাদের প্রতিটি এলাকার প্রতিটি গুম-খুনের জবাব দিতে হবে।
আলোচনা সভায় আরও বলা হয়, সরকার অগণতান্ত্রিক এবং জনবিচ্ছিন্ন হওয়ায় তারা এখন জনগণকে তথাকথিত উন্নয়নের গল্প শোনায়। উন্নয়নের নামে সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যাবে না। দেশকে আন্তর্জাতিক বিশ্বে তুলে ধরার জন্য প্রতিটি দেশেরই নিজস্ব কিছু “ঐতিহ্য বা নিদর্শন” থাকে। বাংলাদেশের রয়েছে সুন্দরবন। শেখ হাসিনার কোথাও কোনো কমিটমেন্ট থাকলে সেটা সুন্দরবনের বিনিময়ে হতে পারে না।
তারা বলেন, একযোগে ফারাক্কার সব বাঁধ খুলে দেওয়ায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলে মারাত্মক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হওয়ায় এমন জনদুর্ভোগেও তার সরকার দেশ ও জনগণের পক্ষে একটি বাক্যও উচ্চারণ করতে পারছে না।
সভায় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং সভাপতিত্ব করে যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর ডক্টর এম এ মালেকসহ অনেকে। আলোচকরা দাবি করেন, জনগণ বিশ্বাস করে বিএনপির মাধ্যমেই দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন, মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধান সম্ভব। তাই যতবারই জনগণ নিরপেক্ষভাবে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে, তারা বারবার বিএনপিকে ভোট দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ করে দিয়েছে। তিনি বলেন, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ছিলেন সবদিক থেকেই একজন সফল ব্যক্তিত্ব। শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের শাসনামল তুলনা করলে জিয়াউর রহমানই সফল। ’৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সব দলকে নিষিদ্ধ করেছিলেন আর ’৭৬ সালে জিয়াউর রহমান সব দলকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
বক্তারা দাবি করেন, জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ দাবি করে জিয়াউর রহমান নাকি শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছেন। এটি যদি সত্য বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে তো প্রমাণ হয়, জিয়াউর রহমানকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে শেখ মুজিব মেনে নিয়েছেন। কারণ প্রথম ঘোষণায় নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে উল্লেখ করেই জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে শেখ মুজিব কখনই এর বিরোধিতা করেননি।
তাদের দাবি, শহীদ জিয়ার সাফল্যের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে আওয়ামী লীগ এখন শহীদ জিয়া এবং জিয়া পরিবারকে তাদের অপপ্রচারের টার্গেটে পরিণত করেছে। জনম্যান্ডেটহীন সরকার নাকি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহার করতে চায়। অথচ দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং গৌরবজনক “স্বাধীনতা পদক” এবং “একুশে পদক” প্রবর্তন করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান বীরোত্তম।
তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক স্বার্থে আদালতকে ব্যবহার করছেন। রাজনৈতিক ইস্যু আদালতে নেওয়া ঠিক নয়। ইতিহাস রচনার ভার আদালতের কাছে দেওয়া উচিত নয়। কার শাসনামল ভালো কিংবা কার শাসনামল মন্দ সেটি বিচারের ভারও আদালতের হাতে দেওয়া সমীচীন নয়। সেটি বিচার করবে জনগণ, সেই বিচার হবে জনতার আদালতে।
জঙ্গি প্রসঙ্গে তারা বলেন, ১৯৯৬ থেকে ২০০০ শেখ হাসিনা সরকারের সময় দেশের সবচেয়ে বড় দুই জঙ্গি শায়খ আব্দুর রহমান এবং মুফতি হান্নানের উত্থান। শায়েখ আব্দুর রহমান ছিলেন শেখ হাসিনার বর্তমান অবৈধ সরকারের পাটমন্ত্রী এবং আওয়ামী যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর্জা আজমের আপন ভগ্নিপতি। অপরদিকে জঙ্গি মুফতি হান্নানের বাড়ি এবং শেখ হাসিনার বাড়ি একই এলাকায় গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায়। ক্ষমতায় থাকার সময় ১৯৯৭ সালের ৩০ জানুয়ারি শেখ হাসিনা মুফতি হান্নানের ছোট ভাই গোপালগঞ্জের ছাত্রলীগ নেতা মুন্সী আনিসুল ইসলামকে গোপালগঞ্জে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পনগরীর ৭ নম্বর প্লটে চার হাজার ৫০০ বর্গফুট জমি বরাদ্দ দিয়েছিলেন। অপরদিকে গত জুলাই মাসে গুলশানে জঙ্গিহামলার নেতৃত্বদানকারী রোহান ছিল ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা ইমতিয়াজের ছেলে।
তারা বলেন, আওয়ামী লীগের জঙ্গি কানেকশন থাকার পরও দেশের স্বার্থে জঙ্গি দমনে বিএনপি জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু সবাই জানেন, আওয়ামী লীগ ঐক্যের পক্ষে নয়।
বর্তমান সরকারের সমালোচনা করে তারা বলেন, এ সরকারের আমলে দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিটি ব্যাংক বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিণত হয়েছে লুটপাটের কেন্দ্রে। গত ১৮ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে একজন বক্তা বলেন, এনবিআর বলেছে, তারা গত ৫ অর্থবছরের ৪৭ হাজার ২২৩ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করে সমুদয় টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে। অথচ অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও মহাহিসাব নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় বলছে, এ অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা হয়নি। কে দেবে জনগণের ট্যাক্সের ৪৭ হাজার ২২৩ কোটি টাকার হিসাব? গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাচার হয়ে আটশ কোটি টাকা কেমন করে গেল ফিলিপাইনের ক্যাসিনোতে। কে দেবে এসব টাকার হিসাব?
তারা বলেন, দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতেই আন্দোলন করতে গিয়ে সারাদেশে দলের হাজারো নেতাকর্মী গুম-খুন হয়েছেন। হামলা মামলায় নির্যাতন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। দলের এসব নেতাকর্মীদের কী অপরাধ? তাদের একটাই অপরাধ, তারা ভোটারবিহীন বর্তমান অগণতান্ত্রিক সরকারের বেআইনি কর্মকা-ের প্রতিবাদ করেছে। একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করেছে। সভায় হতাহত ও নির্যাতিতদের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া ও মোনাজাত করা হয়।