আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাফল্য
৩০ আগস্ট ২০১৬ ঘটল আরও একটি সাফল্যের ঘটনা। ন্যায্য বিচার পাওয়ার সংস্কৃতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো। যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ খারিজ করে দিয়েছে। কাসেম হলো ষষ্ঠ যুদ্ধাপরাধী, যার সর্বোচ্চ সাজার রায় কার্যকরের পর্যায়ে এসেছে। এই ব্যক্তি হলো জামায়াতের পঞ্চম শীর্ষ নেতা, শেষ বিচারেও যার মৃত্যুদ- বহাল রাখা হলো। প্রকৃতপক্ষে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য সুষ্ঠু, স্বচ্ছ এবং পরিকল্পিতভাবে পরিচালনা করে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ বাংলাদেশ ও বিশ্বের কাছে একটি আস্থার সংস্থায় পরিণত হয়েছে।
অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে সাক্ষী হাজির করা এবং তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে রায় প্রদান ও সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে মামলা পরিচালনায় নির্ভীক থাকায় ট্রাইব্যুনালের সকল সদস্য প্রশংসা অর্জন করেছেন। অন্যদিকে রায় কার্যকর করার সময় শেখ হাসিনা সরকারকেও বিচিত্র চাপ সামলাতে হয়েছে। ২০১৫ সালের ২৮ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদ- পাওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের মুক্তি চেয়ে বিবৃতি দেয় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। ১৮ নভেম্বর তাদের ফাঁসির রায় ঠেকাতে পাকিস্তানকে সরব হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির সিরাজুল হক। অন্যদিকে পৃথিবীর ক্ষমতাবান রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তিরাও অপরাধীদের পক্ষাবলম্বন করেন। ভয়ভীতি, চাপ উত্তীর্ণ হয়ে যুদ্ধাপরাধীদের রায় ঘোষণা এবং রায় কার্যকর করার সাফল্যে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে উদ্ভাসিত নক্ষত্র।
২.
৩০ আগস্টের আগেই যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল কাসেমের বিচারে সাফল্য দেখায়। ৮ মার্চ ২০১৬ সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে সাজা বহাল থাকে একাত্তরের বদর নেতা মীর কাসেম আলীর। এখন তাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলান হবে। আপিল বিভাগে যুদ্ধাপরাধ মামলায় এর আগের ছয়টি রায়ের মধ্যে চারটিতে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, দলটির সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আপিল বিভাগের আরেক রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়া হয়েছে। সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হওয়ার পর দুই পক্ষের করা রিভিউ আবেদন এখন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। আর সর্বশেষ রায়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর সর্বোচ্চ সাজা বহাল রেখেছিল আপিল বিভাগ। ওই রায়ের দ- কার্যকর হয়েছে। শুনানি চলার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমির গোলাম আযম ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের মৃত্যু হওয়ায় তাদের আপিলের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। উল্লেখ্য, জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের পর মীর কাসেম ছিল আলবদর বাহিনীর তৃতীয় প্রধান ব্যক্তি। তার যোগানো অর্থেই স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী পেয়েছে শক্ত ভিত্তি। দেড় বছর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে দুই অভিযোগে মীর কাসেমের মৃত্যুদ- এবং আট অভিযোগে সব মিলিয়ে ৭২ বছরের কারাদ- হয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটায়। একাত্তরে তার নির্দেশেই চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিস সংলগ্ন এলাকায় হিন্দু মালিকানাধীন মহামায়া ভবন দখল করে নাম দেওয়া হয় ডালিম হোটেল। সেখানে গড়ে তোলা হয় বদর বাহিনী চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঘাঁটি এবং বন্দিশিবির। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেখানে অসংখ্য মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়, যাদের লাশ পরে ফেলে দেওয়া হতো চাক্তাই চামড়ার গুদাম সংলগ্ন কর্ণফুলী নদীতে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম চট্টগ্রাম অঞ্চলে সরাসরি মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত হয়। পঁচাত্তরে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর জিয়াউর রহমান জামায়াতকে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্রসংঘ নাম বদলে ইসলামী ছাত্রশিবির নামে বাংলাদেশে রাজনীতি শুরু করলে মীর কাসেম তার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হয়। ১৯৮০ সালে মীর কাসেম যখন সরাসরি জামায়াতের রাজনীতিতে যোগ দেয়। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের আমলে ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড গঠন হলে মীর কাসেম প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান হয়। দলে দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে ১৯৮৫ সালে হয় জামায়াতের শুরা সদস্য। ২০১২ সালে গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত মীর কাসেম দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনেরও চেয়ারম্যান ছিল। ওই প্রতিষ্ঠানেরই সংবাদপত্র দৈনিক নয়াদিগন্ত এবং টেলিভিশন চ্যানেল দিগন্ত টেলিভিশন। ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের অবস্থান নিয়ে ধর্মীয় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে দিগন্ত টেলিভিশন বন্ধ করে দেওয়া হয়।
৩.
২০১০ সালের ২৯ জুন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ গ্রেফতার করার মধ্য দিয়ে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’-এর কাজ শুরু হয়। একইদিন যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেফতার করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর সাকা চৌধুরী গ্রেফতার হয়। ২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচার শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ২৩ সেপ্টেম্বর একই অভিযোগে সুবহানকে আটক করেন আদালত। ২০১৩ ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে গতিশীল কার্যক্রমের বছর। এবছর ২১ জানুয়ারি গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর পলাতক নেতা আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে মৃত্যুদ-ের আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করেন একই আদালত। যদিও পরে আপিলে তাকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি একইদলের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদ- প্রদান করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। অবশ্য পরে আপিলে এই অপরাধীর যাবজ্জীবন কারাদ- হয়। ৯ মে জামায়াতে ইসলামীর অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদ- দেন আদালত। ১৭ জুলাই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং সাম্প্রদায়িক হত্যা-নির্যাতনের দায়ে মুজাহিদকে মৃত্যুদ- প্রদান করা হয়।
লেখক : অধ্যাপক এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সম্পাদনা : জব্বার হোসেন