নারাজি দরখাস্তের আইনগত ভিত্তি
থানায় এজাহার দায়েরের মাধ্যমে উদ্ভুত মামলাসমূহের তদন্ত পরবর্তী তদন্তকারী কর্মকর্তা যে প্রতিবেদন দাখিল করেন, সেটিকে বলা হয় পুলিশি প্রতিবেদন। পুলিশি প্রতিবেদনের দুটি অংশ। এর একটি হলো, অভিযোগপত্র এবং অপরটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন। কিছু কিছু পুলিশি প্রতিবেদনে এজাহারভুক্ত সকল আসামিকে বিচারের জন্য সোপর্দ করা হয়।
এ ধরনের বিচারের জন্য সোপর্দকৃত আসামিদের বলা হয়, অভিযোগপত্র দায়েরকৃত আসামি। আর যেসব আসামিকে বিচারের জন্য সোপর্দ করা হয় না, তাদের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তা এ ধরনের আসামিদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলপূর্বক তাদেরকে অব্যাহতি প্রদানের জন্য সুপারিশ করেন।
এমন অনেক মামলা রয়েছে, যেখানে তদন্তকারী কর্মকর্তা কিছুসংখ্যক আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দায়ের করেন, আবার কিছু কিছু আসামির ক্ষেত্রে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা এজাহারে নাম নেই এমন ব্যক্তিকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে তদন্ত প্রতিবেদনে যেমন বিচারের জন্য সোপর্দ করতে পারেন তেমনি চূড়ান্ত প্রতিবেদনও দাখিল করতে পারেন। সাধারণত দেখা যায়, তদন্তে যে সকল আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ সাক্ষ্য দ্বারা সমর্থিত হয় তাদের বিষয়ে অভিযোগপত্র দেওয়া হয় আর যাদের বিষয়ে অভিযোগ সাক্ষ্য দ্বারা সমর্থিত হয় না তাদের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। তদন্তকারী কর্মকর্তাকর্তৃক দাখিলকৃত অভিযোগপত্র বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন গৃহিত হওয়া বা না হওয়ার বিষয়টি একজন ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারকের বিচারিক এখতিয়ার।
তদন্ত প্রতিবেদন দ্বারা বিক্ষুব্ধ মামলার যেকোনো পক্ষ যখন এর বিরুদ্ধে আপত্তি দাখিল করেন তখন এটিকে বলা হয় নারাজি দরখাস্ত। ফৌজদারি কার্যবিধির কোথাও নারাজি দরখাস্তের বিষয় উল্লেখ না থাকলেও দীর্ঘদিনযাবৎ আমাদের বিচারাঙ্গনে ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারককর্তৃক এ ধরনের দরখাস্ত গ্রহণ পরবর্তী শুনানিঅন্তে তা মুঞ্জুর অথবা নামঞ্জুরের প্রথা চলে আসতে থাকায় এটি আইনগত অবস্থান লাভ করেছে। একজন ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারক নারাজি দরখাস্ত মঞ্জুর বা নামঞ্জুর যাই করুন না কেন এর দ্বারা সংক্ষুব্ধ যেকোনো পক্ষ পরবর্তী উচ্চতর আদালতে রিভিশন দায়ের করে থাকেন এবং রিভিশনাল আদালত নিম্ন আদালতের আদেশ বহাল রাখেন অথবা বাতিল করে থাকেন।
পুলিশি মামলার ক্ষেত্রে মামলার বাদি সরকারি-বেসরকারি উভয় ব্যক্তি হতে পারেন। এরূপ মামলায় সচরাচর সরকারি ব্যক্তি মামলায় বাদি হয়ে থাকলে তাকে নারাজি দরখাস্ত দাখিল করতে দেখা যায় না, অপরদিকে বেসরকারি ব্যক্তি বাদি হয়ে থাকলে নারাজি দরখাস্ত দাখিলের ঘটনা বিরল নয়।
বেসরকারি ব্যক্তিকর্তৃক দাখিলি দরখাস্তের ভিত্তিতে যে সকল মামলা রুজু হয় সেসব মামলাকে বলা হয় নালিশি মামলা। নালিশি মামলার ক্ষেত্রে একজন আমলি ম্যাজিস্ট্রেট দরখাস্তের বস্তুনিষ্ঠতার বিষয়ে সন্তুষ্ট হলে তাৎক্ষণিক মামলা আমলে নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে সমন অথবা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারেন অথবা মামলা আমলে না নিয়ে মামলার বিষয়টি তদন্ত করে দেখার জন্য কোনো সরকারি বা বেসরকারি ব্যক্তিকে নির্দেশনা দিতে পারেন। এ ধরনের নির্দেশনাপ্রাপ্ত হয়ে সরকারি বা বেসরকারি ব্যক্তি যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন এর ফলাফলের উপর নির্ভর করে একজন আমলি ম্যাজিস্ট্রেট মামলাটি আমলে নিবেন কি নিবেন না। আর আমলে না নিয়ে থাকলে ম্যাজিস্ট্রেট যে আদেশ প্রদান করেন সেটিকে বলা হয় দরখাস্তের খারিজ আদেশ।
পুলিশি মামলার ক্ষেত্রে যতক্ষণ পর্যন্ত না ম্যাজিস্ট্রেটকর্তৃক তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণপূর্বক মামলা আমলে নেওয়া না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেট আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতের পরোয়ানা অর্থাৎ সমন বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত নন। আর তাই পুলিশকর্তৃক এজাহারের কপি ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট প্রেরণের অর্থ এ নয় যে, তদন্তভিত্তিতে ম্যাজিস্ট্রেট তদন্ত প্রতিবেদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে কোনো ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করবেন।
পুলিশি বা নালিশি মামলার ক্ষেত্রে আমলে নেওয়া পরবর্তী একজন ম্যাজিস্ট্রেট কোন কোন অপরাধের ক্ষেত্রে প্রথমতঃ সমন এবং কোন অপরাধের ক্ষেত্রে প্রথমতঃ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করবেন তা ফৌজদারি কার্যবিধিতে নিশ্চিত করা হয়েছে। এর ব্যত্যয়ে ম্যাজিস্ট্রেট পরিপন্থি কোনোকিছু করলে তা আইনের লংঘন হিসেবে গণ্য হয়। একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট হতে বিচার প্রার্থীরা সবসময় আইনানুগ আদেশ প্রত্যাশা করে। আইনের পরিপন্থি যেকোনো আদেশ আইনানুগ আদেশ নয় এবং এমন আদেশ প্রদান হতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়।
মামলার চূড়ান্ত বিচারিক আদেশ ও জামিন মঞ্জুর বা নামঞ্জুর আদেশ ব্যতীত একজন ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারকের অপরাপর যেকোনো অন্তর্বর্তী আদেশের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি পরবর্তী উচ্চাদালতে প্রতিকার চেয়ে যে আবেদন করেন সেটিকে বলা হয় রিভিশন। অভিযোগপত্র বা চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধতায় মামলার যেকোনো পক্ষ প্রতিকার প্রার্থনায় যে আবেদন করেন তা আদেশের প্রতি অসম্মতির ভিত্তিতে হয় বিধায় আদালতের প্রচলিত ভাষায় এটির নামকরণ হয়েছে নারাজি দরখাস্ত।
বিচারিক আদালতকর্তৃক নারাজি দরখাস্তের উপর শুনানি গ্রহণ এবং শুনানিঅন্তে আদেশের দ্বারা সংক্ষুব্ধতায় যেকোনো পক্ষকর্তৃক পরবর্তী উচ্চাদালতে রিভিশন দায়েরের প্রথা বলবৎ থাকায় ফৌজদারি কার্যবিধি নারাজি বিষয়ে নিশ্চুপ থাকা সত্ত্বেও তা আইনগত ভিত্তি লাভ করেছে যা অনেকটা প্রথাগত আবার অনেকটা মামলার বিচারিক সিদ্ধান্ত দ্বারা প্রতিষ্ঠিত।
সম্পাদনা: জব্বার হোসেন