দায়মুক্তির পথে বাংলাদেশ
ওয়াসিম ফারুক
মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী মৃত্যুদ-ের রায় পুনঃবিবেচনা চেয়ে করা রিভিউ পিটিশন খারিজ হওয়ার মধ্য দিয়ে জাতি আজ কলঙ্কমুক্তির পথে। কিন্তু এত সহজে আসেনি গণদাবির এই সফলতা। এ জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে জাতিকে। এই বিচারকাজকে নানাভাবে বিতর্কিত করার প্রয়াস চালানো হয়েছিল। চলমান একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালকে নানাভাবে বিতর্কিত করতে অনেক অর্থ খরচ করে লবিং করেছিলেন, প্রভাব খাটিয়ে বিচার বন্ধ করার অপচেষ্টা করেছিলেন যিনি, তিনিই মীর কাসেম আলী। মীর কাসেমের রিভিউয়ের রায় নিয়ে নানা প্রশ্ন, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষশক্তি। তবে সব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, জল্পনা-কল্পনার অবসান হয়েছে, মীর কাসেমের মৃত্যুদ-ের বিরুদ্ধে করা রিভিউ পিটিশন খারিজ হওয়ার মধ্য দিয়ে। দায়মুক্তির পথেই রয়েছে বাংলাদেশ।
এ দেশে মীর জাফর কিংবা মীর কাসেমদের জন্ম বারবার হয়েছে। মীর জাফর বা মীর কাসেমদের ষড়যন্ত্র মানুষ রুখে দিয়েছে জীবন ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে। কিন্তু ষড়যন্ত্র থামেনি, এখনও চলছে। এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত একাত্তরের পরাজিত শক্তি, এর বাইরেও রয়েছে নানা অপশক্তি। পঁচাত্তরে পটপরিবর্তনের পর থেকেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে প্রায় প্রতিটি সরকার-ই একাত্তরের পরাজিত শক্তিকে কাজে লাগিয়েছে। সরকারগুলোর একরকম পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতির আড়ালে নিজেদের নানাভাবে স্বাবলম্বি করতে সমর্থ হয়েছে জামায়াত।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি স্বাধীনতার পর থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সর্বসময়ই তৎপর ছিল। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো জনতার উপস্থিতিতে ‘জনতার কাঠগড়া’য় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের এক প্রতীকী ট্রায়ালের মাধ্যমে গোলাম আযমসহ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদ-যোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা দেন। তারপর থেকেই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি গণদাবিতে পরিণত হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে যখন যারাই শক্ত অবস্থান নিয়েছেন, আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, তাদের নানা নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা মাথায় নিয়েই মারা পার্থিব জগত ত্যাগ করতে হয়েছে।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের মূলে ছিল, নির্বাচনি ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এজেন্ডাভুক্ত করা। বিপুল সংখ্যক তরুণ আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থা রাখে। তার ফলেই নির্বাচনে এমন বড় বিজয় পেয়েছিল দলটি। যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে নানা সমালোচনা থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে, এই বিচার এখন শেষের পথে। বাংলাদেশও কলঙ্কমুক্তির পথেই রয়েছে। এ জন্য সাধুবাদ পেতেই পারে বর্তমান সরকার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষ প্রশংসা করতে কার্পণ্যও করছে না।
স্বাধীনতাবিরোধিরা একাত্তরে নিজ দেশের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছিল ধর্মের অজুহাতে। মুক্তিযুদ্ধকে হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ বলে চালানোর চেষ্টাও করা হয়েছিল, যাতে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মুসলমানের সমর্থন আদায় করা সহজ হয়। কিন্তু তারা সফল হয়নি। মুক্তিকামী বাঙালি বিভ্রান্ত করতে পারেনি। সরাতে পারেনি মুক্তির আন্দোলন থেকে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের চাওয়া ছিল। তাদের এই চাওয়া পূরণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহসিকতার পরিচয় রেখেছেন। এই বিচারে তার ভূমিকা অনন্য। অসাধারণ। দেশ-বিদেশের নানা চাপ উপেক্ষা করে একাত্তরের মানবতাবিরোধিদের বিচার শেষ করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। কঠিনকেই তিনি সহজ করেছেন। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা বলেই তা সম্ভব হয়েছে। জনকের রক্ত তো তার শরীরেই প্রবাহমান।
এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যথাযথভাবে শেষ করা যেমন এই সরকারের দায়িত্ব, তেমনি শহীদদের রক্তে কেনা এদেশের মাটিতে সংগঠন জামায়াতের রাজনীতিও দেখতে চায় না মানুষ। জামায়াত নিষিদ্ধ ও তার আয়ের উৎসশক্তি যদি বন্ধ করা যায়, তাহলে এদেশ থেকে উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদের অপতৎপরতা অনেকাংশেই বন্ধ করা সম্ভব হবে বলেই বিশ্বাস করেন সাধারণ মানুষ। প্রত্যাশা, গণমানুষের এই দাবির প্রতি সম্মান জানাবে সরকার। কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করে সংগঠন জামায়াতের বিচারও শেষ করবে।
লেখক: কলামিস্ট/ সম্পাদনা : আশিক রহমান