বুরকিনির মতো শালীন পোশাক সব ধর্মেই রয়েছে
মমিনুল ইসলাম: গত সপ্তাহে একটি মর্মান্তিক ছবি পুরো ইন্টারনেট বিশ্বকেই নাড়িয়ে দিয়েছে। যে ছবিতে দেখা যায়, একজন মুসলিম নারী একটি সৈকতে পরিপূর্ণ পোশাক পরে রয়েছেন। আর তাকে ঘিরে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। তারা ওই নারীকে তার পোশাক সরাতে বাধ্য করছেন। ফ্রান্সের দক্ষিণে উপকূলীয় শহরগুলোতে বুরকিনির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরপরই এমন ছবি ব্যাপকভাবে তোলপাড় সৃষ্টি করে। মূলত মুসলিম নারীদের সাঁতারের পোশাক হিসেবে অবিহিত করেই সেখানে বুরকিনি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
বিশ্বব্যাপী সমালোচনার প্রেক্ষিতে অবশেষে বুরকিনির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় ফ্রান্স সরকার। তবে যে বিতর্ক শুরু হয়েছিল তা কার্যত এখনও চলছে। ফরওয়ার্ডডটকমের এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়, সাঁতারের জন্য বুরকিনির মতো শালীন পোশাক শুধু মুসলিমরা নয়, প্রায় প্রধান সব ধর্মের নারীরা পরে থাকেন। তবে নকশা বা নাম ভিন্ন হলেও এসব পোশাকে শালীনতার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তাই বুরকিনি নিষিদ্ধ করাকে কেবল ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ব্যক্তি স্বাধীনতার লঙ্ঘন বলে মনে করেন অনেকে।
এ প্রেক্ষিতে অনেকেই এখন প্রশ্ন করেন, আসলে বুরকিনি কি? এটা একটা শালীন সাঁতারের পোশাক, যা নারীদের ঘাড়ের নিচ থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঢেকে রাখে। সাঁতারকাাঁর জায়গায় এ পোশাক পরা হয়। এছাড়াও এ পোশাকে একটি নরম টুপি বিশেষ বা ঢিলে স্কার্ফ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সাঁতার কাাঁর সময় যেসব নারী চুল ঢেকে রাখতে চায় তারা এটা পরে। খ্রিস্টান ও ইহুদি নারীরাও ধর্মীয় শালীনতার বিবেচনায় এমন পোশাক পরেন। ডুবুরিরা পুরো শরীরে যে রবারের অঁাঁসাঁ পোশাক পরেন এটা অনেকটা তার মতো। পানিতে খেলা করার সময় অসংখ্য মানুষ এমন পোশাক পরেন।
ফ্রান্সে নিকাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার মাত্র ছয় বছর পর বুরকিনি নিষিদ্ধের ঘটনা ঘটে। এখন থেকে ১২ বছর আগে দেশটিতে সরকারি স্কুলে হিজাবের মতো ধর্মীয় পোশাক পরার ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। অথচ দেশটি সবার কাছে স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব রক্ষার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত স্বাধীনতা বা সাম্যের দৃষ্টিতে প্রত্যেককে দেখা হয় না। বিশেষত মুসলিমদের। ফ্রান্সে অব্যাহতভাবে আইনের পরিবর্তন করা হচ্ছে। আর এতে কেবল মুসলিমরা অব্যাহতভাবে টার্গেটে পরিণত হচ্ছে এবং তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য করা হচ্ছে। যদিও দেশটির সরকার জোর দিয়ে বলে হিজাব, বোরকা অথবা বুরকিনি যাই হোক না কেন তাদের তা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।
ফ্রান্স ধর্ম নিরপেক্ষতার জন্য একটি ব্রান্ড। রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে সম্পূর্ণ পৃথক করা হয়েছে। সেখানে এমন নিষেধাজ্ঞা ও নারীর শরীর থেকে পুলিশের পোশাক সরানোর প্রচেষ্টা কি নির্দেশ করে? বুরকিনিকে ভয়ঙ্কর ধর্মীয় প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। তাদের অত্যাচার করা হয় ও সমাজে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখা হয়।
বুরকিনি উদ্ভাবনের আগেও কিছু মুসলিমকে বিচ বা পুলে দেখা যেত। সেসময় শরীর প্রকাশ ছাড়া তারা পানিতে তেমন কিছু করতে পারত না। আর এ কারণেই অনেক মুসলিম নারী সাঁতার কাটতে জানে না। অবশেষে বুরকিনি ও অন্যান্য শালীন পোশাকের উদ্ভাবন ঘটল যারা শালীন পোশাক পরতে পছন্দ করে তারা শরীরের এক ইঞ্চি পরিমাণ প্রকাশ ছাড়াই সাঁতার শিখতে সক্ষম হয়। শালীনতার প্রতি তাদের যে বিশ্বাস ছিল তা ছাড় দেওয়া ছাড়াই এমনটি করতে সক্ষম হয়।
কিন্তু ফ্রান্স সরকার দুর্ভাগ্যবশত এভাবে দেখতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা বুরকিনিকে অন্যান্য মুসলিম পোশাকের মতো করে বিবেচনা করেছে। মুসলিমরা যে শালীন পোশাক পরে তা মেনে নিতে ব্যর্থ হয়েছে। মুসলিম নারীরা এমন পোশাক স্বামী, বাবা বা ভাইয়ের চাপে পরে না। তারা দৃঢ় শালীনতার কারণে পরে থাকেন। একইভাবে খ্রিস্টান ও ইহুদিদের ধর্ম প্রিয় নারীরাও শালীন পোশাক স্বেচ্ছায় পরে থাকেন। তাই বুরকিনি, হিজাব, নিকাবের মতো পোশাক নিষিদ্ধ করা এবং যারা নারীদের শালীন পোশাক পরতে বাধ্য করে তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আর এটা পাশ্চিমা স্বাধীনতার নামে কেবলই নিপীড়ন। বৈষম্য মুসলিমদের বিরুদ্ধে।
আবার এমন নিষেধাজ্ঞাকে নারীর ওপর পুরুষের প্রাধান্য হিসেবে দেখা হয়। কেননা অনেক পুরুষ পানিতে খেলার সময় পুরো শরীরে রবারের লম্বা পোশাক পরেন (ওয়েটসুইট)। বুরকিনির সঙ্গে এর তেমন কোন পার্থক্য নেই। পুরুষরা একই অঙ্গ ঢেকে এমন পোশাক পরলে তাদের টার্গেট করা হয় না। কেবল বুরকিনিকে ইসলামের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। মূলত এখানে বুরকিনি শালীন কিনা তা বিবেচনা না করে কোন ধর্মের মানুষ ব্যবহার করছে তার ওপর বিবেচনা করা হচ্ছে। যা স্পষ্টত ধর্মীয় বৈষম্য।
আমরা সবাই তা জানি, কাপড় যতক্ষণ না শরীরে পরা হয় ততক্ষণ তা মূল্যহীন। যখন ফ্রান্স সরকার একই বৈশিষ্টের পোশাক পরা একদলের জন্য বৈধতা দেয় আর অন্যদের জন্য দেয় না তা সত্যিই উদ্বেগের। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে একই পোশাক হলেও কেবল মুসলিমদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে।
-লাইভ মিন্ট, রয়টার্স, গার্ডিয়ান।