জঙ্গি ইস্যুতে দুশ্চিন্তা কমেছে সরকারের
দীপক চৌধুরী: সন্ত্রাসী-জঙ্গি তা-বের ঘটনায় সরকারের কঠিন পদক্ষেপ প্রশংসিত হয়েছে দেশি ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে। রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারি ও শোয়ালাকিয়ায় ঈদ জামাতে জঙ্গি-সন্ত্রাসী হামলায় তাৎক্ষণিক সরকারি পদক্ষেপ প্রশংসিত হয়েছে বিদেশি প্রচার মাধ্যমেও। এসব হামলায় নিহত ২৫ দেশি-বিদেশি নাগরিক।
পরবর্তীকালে কল্যাণপুরে পুলিশের অ্যাকশনে নয় জঙ্গি নিহতের পর অস্ত্র উদ্ধার এবং নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় গুলশান হামলার ‘মাস্টার মাইন্ড’ তামিম চৌধুরীসহ তিনজন নিহতের পর পুলিশের তৎপরতায় সরকারের দুশ্চিন্তা কমে এসেছে। জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এখন পুলিশের কব্জায়।
গতকাল কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, গুলশান হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেডগুলো সোহেল মাহফুজ সরবরাহ করেছিলেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি জেএমবির পুরনো ধারার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ‘নিউ জেএমবি’ নামে জঙ্গিরা এখন যে ধরনের নতুন তৎপরতা শুরু করেছে, এই তৎপরতার সঙ্গে তার সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। পুলিশ তাকে খুঁজছে। তিনি বলেন, জেএমবির পুরনো ধারার সক্রিয় সদস্য সোহেল মাহফুজ রাজধানীর গুলশানে স্প্যানিশ রেস্তরাঁ হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার বোমা প্রস্তুতকারী ও গ্রেনেড সরবরাহকারী ছিলেন।
জানা গেছে, পুলিশ-র্যাবের রুটিন ওয়ার্কের বাইরে ব্যাপক সতর্কতা ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনাও সন্তুষ্ট। নিরাপত্তার প্রয়োজনে ও জঙ্গি-সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমে দক্ষতার নজির সরকারের সামনে তুলে ধরেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা।
গুলশানকা- বাংলাদেশের ইতিহাসের ভয়াবহতম জঙ্গিহামলা। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গুলশানের রেস্তারাঁয় হামলাকারীদের সঙ্গে আন্তদেশি উগ্রপন্থি গোষ্ঠীগুলোর সম্পর্ক থাকার সম্ভাবনার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন একাধিক নিরাপত্তা কর্মকর্তা। এ সন্ত্রাসী হামলায় দেশি-বিদেশি নাগরিকদের নৃশংস হত্যার পর আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশের নিরাপত্তাসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠে। হামলার ঘটনাটিতে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিল একজন মার্কিন নাগরিক। আরো রয়েছে অন্তত নয়জন ইতালীয় ও সাতজন জাপানি নাগরিক। এ বিষয়ে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ ও পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে গত জুলাইয়ের শেষভাগে ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের ‘ব্রিফ’ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জন কেরির বৈঠকে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় যৌথভাবে কাজ করার বিষয়টিও গুরুত্ব পায়। কেরি উল্লেখও করেছেন, ‘সন্ত্রাস বৈশ্বিক সমস্যা।’ বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সতর্কতার মধ্যেই ঢাকা ঘুরে গেছেন কেরি। এটা ইতিবাচক বলে মনে করেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।
গতকাল শুক্রবার সরকারের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি মনে করিÑ সরকারের অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি পরিস্থিতি সম্পর্কে বিভিন্ন দেশ কী ভেবেছিল বাংলাদেশ নিয়ে তা-ও তাদের জানার চেষ্টা সহজ হয়। এর পরবর্তীকালে নেওয়া সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপে বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও কূটনীতিকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। সরকারের ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, গুলশানে রেস্তরাঁয় হামলার দায় স্বীকার করে আইএস। এমনকি যখন জিম্মি ঘটনা চলছিল, তার মধ্যেই এই গোষ্ঠী রেস্তরাঁর ভেতরের ভয়াবহ ছবি প্রকাশ করে। হামলাকারী জঙ্গিরাই দৃশ্যত ছবিগুলো পাঠায়। গুলশানের ঘটনা তুরস্কের ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যেসব হামলা হয়েছে সেগুলোর অংশ নাকি হামলাগুলোর মাধ্যমে উৎসাহিত হয়ে এটি ঘটানো হয়েছে এ প্রশ্নও ওঠে।
গতকাল প্রেসক্লাবে এক অনুষ্ঠানে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেছেন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ঢাকায় এসে যে কথাটি বলার চেষ্টা করেছেন, তা হলো বাংলাদেশের জঙ্গিদের সঙ্গে আইএসের যোগসূত্র রয়েছে। আমরাও এটা কখনো অস্বীকার করিনি। আমরা বলে এসেছি, এই জঙ্গিদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে পাকিস্তানের আইএসআই ও অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে।
পুলিশের সন্ত্রাস দমন শাখার একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, প্রতিটি ঘটনায়ই দেখা গেছেÑ হামলা ও জিম্মি করার ঘটনায় জঙ্গি অস্ত্রধারীর সবাই বাংলাদেশের স্থানীয়। গত কয়েকমাস ধরে ব্লগার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের হত্যা এবং বেশ কয়েকজনের ওপর যে হামলা হয়েছে, তার জন্য দেশি দুই প্রধান জঙ্গিগোষ্ঠীকে দায়ী করা হয়। দেশি এ দুই জঙ্গিগোষ্ঠীর মধ্যে আনসার-আল-ইসলামকে তুলনামূলকভাবে বেশি সংগঠিত ও বিপজ্জনক বলে ধারণা করা হয়।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে কোনো বিদেশি জঙ্গি নেই বলে দীর্ঘদিন ধরেই বলা হচ্ছিল। যদিও কিছুসংখ্যক পশ্চিমা নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এ দাবির ব্যাপারে প্রশ্ন তুলছিলেন। কয়েকটি চাঞ্চল্যকর জঙ্গি-সন্ত্রাসী হামলার পর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে ও সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোর দিয়ে বলেছেন, যারা গুপ্তহত্যার সঙ্গে জড়িত তাদের ‘খুঁজে খুঁজে’ বের করা হবে।
গুলশান ও শোয়ালাকিয়ার নৃশংসতার পর জাতিসংঘের নিরাপত্তাবিষয়ক বিভাগের জারি করা আদেশেÑ পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বিদেশি কর্মকর্তাদের ঢাকার বাইরে যাওয়া স্থগিত, রাজধানীর দুটি পাঁচ তারকা হোটেল ও বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র ছাড়া অন্য কোথাও অনুষ্ঠান আয়োজন না করা এবং বিদেশি কর্মকর্তা তাদের পরিবারের সদস্যদের নৈশ ক্লাবসহ জনসমাগমের স্থলে যেতে নিষেধ করা হয়েছিল।