আবারো তারা শরণার্থী?
নূসরাত জাহান : পাকিস্তান সীমাস্তে আশ্রয় নেওয়া ৩০ লাখ আফগান শরণার্থীকে যত দ্রুত সম্ভব আফগানিস্তানে ফিরে যেতে বলেছে ইসলামাবাদ। সীমাস্তে ও দেশের ভেতর বিশৃঙ্খলা হচ্ছে, এই কারণ দেখিয়ে তাদের ফিরে যেতে বলা হয়েছে। এই ৩০ লাখ আফগান নাগরিকের মধ্যে অনেকেই তার জীবনের বড় অংশ পাকিস্তানের পার করেছেন। তাদেরই সঙ্গে কথা বলেছেন, বিবিসির পেশোয়ারের রিপোর্টার ইলিয়াস খান।
শরণার্থীদের একজন নূর মোহাম্মদ। আফগানিস্তানে প্রবেশের জন্য তিন দিন ধরেই সীমাস্ত থেকে তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছেন। কারণ, সীমাস্তে শরণার্থীদের লরির দীর্ঘ লাইন। আরো হয়তো কয়েকদিন লাগবে সীমাস্ত পার হতে। ৩৭ বছর পর নিজ দেশে ফিরছেন। কিন্তু নূর মোহাম্মদের চেহারায় নেই তৃপ্তির ছায়া।
১৯৭৯ সালের শীতকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাবাহিনী আফগানিস্তানে ঢুকে পড়ে এবং হেলিকপ্টার থেকে তার গ্রাম বাঘলানে গুলিবর্ষণ শুরু করে। তখন তার বয়স ১২ কী ১৩ হবে। গ্রাম থেকে পরিবারের সঙ্গে পাকিস্তানে আসার সেই কষ্ঠকর স্মৃতির কথা এখনও ভোলেননি তিনি।
তিনি বলেন, ‘পাহাড়ের ওপর দিয়ে আমরা দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করি। অনেকদিন ধরে আমরা চলছিলাম। কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো লরিতে, কখনো বা ঘোড়ার পিঠে চড়ে।’ তবে ৩৭ বছর পর দেশে ফিরে যাওয়ার ঝক্কি তার জন্য কষ্টকর। কারণ, তখন কিশোর ছিলেন, এখন বয়স ৫০ এর কোটায়।
এই প্রতিবেদক বলেন, আমার পক্ষে যতদূর সম্ভব ততদূর পর্যস্ত গুনে দেখলাম মালপত্র বোঝাই অস্তত ২০০টির বেশি লরি সীমাস্ত পারাপারের অপেক্ষা রয়েছে।
শরণার্থী বিষয়ক জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনএইচসিআর এবং পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ এক সঙ্গে এতো শরণার্থীর দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত নন, তাতেই এ সংকট।
এসব শরণার্থীদের মধ্যে অনেকেই পাকিস্তানে বাড়িঘর বানিয়েছে। তারা ফরে গেলে আফগান সরকার যে তাদের জন্য শিক্ষা, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে সমর্থ হবে এমন নয়। তারপরও ফিরতে হচ্ছে। কেন এই ফেরা-এর উত্তর শুধু পাকিস্তানই জানে।
ফিরে যাওয়া যাক ১৯৭০ এর দশকে। সোভিয়েত হামলার পর ইরান অস্বীকৃতি জানালেও পাকিস্তান দুবাহু প্রসারিত করে আফগান শরণার্থীদের স্বাগত জানায়। শরণার্থীদের মধ্যে বেশিরভাগই পশতু আদিবাসী গোষ্ঠীর। এ কারণে পাকিস্তানের পশতু জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তারা সহজেই মিশে যায়। আফগানিস্তানের সমাজতাস্তিক মনোভাবের বদলে পাকিস্তানের ইসলামিক আদর্শে জীবনযাপনের শর্ত মেনে নেয় তারা। আফগানিস্তানে প্রভাব বিস্তার করে ভারতকে চাপে ফেলতেই পাকিস্তান ওই সময় শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিল। তবে ৯/১১ হামলার পর তালেবানের নাম ওঠার পর থেকেই দৃশ্যপট বদলে যেতে থাকে। তখন থেকেই আফগান শরণার্থীদের সম্পর্কে পাকিস্তানের মনোভাবের পরিবর্তন হতে শুরু করে। তখন থেকেই শরণার্থীদের ফেরত পাঠাতে তোড়জোড় শুরু করে।
শরণার্থীদের ফেরত যাওয়ার জন্য পাকিস্তান এ পর্যস্ত বেশ কয়েকবার সময়সীমা বেধে দিয়েছে। তবে ইউএনএইচসিআর শরণার্থী শিবিরের ভার পাকিস্তানের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথা জানালে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তান শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার জন্য ছয় মাসের সময়সীমা বেধে দেয়। পরে জুনে আরও ছয় মাসে মেয়াদ বাড়ায়। একই সময় পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মধ্যবর্তী তরখাম সীমাস্ত বন্ধ করে দেয়। পাসপোর্ট না থাকলে সীমাস্ত পার হওয়া যাবে না বলে ঘোষণা দেয়।
তবে নূর মোহাম্মদের কাগজপত্র থাকায় তিনি ফিরে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছেন। তিনি বলেন, ’আমার পরিবারের অনেকে কাবুল চলে গেছে। পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪০ হওয়ার এতো মানুষের একসঙ্গে পাসপোর্ট করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই ভাগে ভাগে করা হয়েছে।’
২১ বছরের খালিদ আমিরি জন্মের কয়েক মাস পর থেকেই পাকিস্তান বাস করছেন। আমিরি পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে পড়ছেন। তার পড়া শেষ হবে আগামী বছরের শেষ নাগাদ। তার মতো এমন ৯ হাজার আফগান শিক্ষার্থী আছেন যারা যানেন না তারা তাদের শিক্ষা কার্যক্রম শেষ করতে পারবেন কিনা। তার মতে ’আফগান ফোবিয়া’র কারণেই শরণার্থীদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, ২০১৪ সালে পেশোয়ারে সামরিক বাহিনীর স্কুলের জঙ্গি হামলার পর থেকে পাকিস্তান পুলিশের রোষানলে পড়েছে শরণার্থীরা। এই রোষ সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়াতে হ্যাশট্যাগ দিয়ে প্রচার করায় আরো বেড়েছে।
আফগান শরণার্থীদের নেতা বারইয়ালি মানখেল আরো কিছুদিন শরণার্থীদের সাহায্য করতে ইউএনএইচসিআর ও পাকিস্তান সরকোরের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
তবে যেসব শরণার্থী আফগানিস্তানে ফিরে যাচ্ছেন তাদের যে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করে নেওয়া হবে বিষয়টি মোটেও এমন নয়। এ কথাটি নূর মোহাম্মদ বেশ ভালো করেই জানেন। কিন্তু তার সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।
তিনি বলেন, ’৩৭ বছর আগে যখন পাকিস্তানে এসেছিলাম তখন তাঁবুতে থাকতাম। সময় এসেছে আবারো তাঁবুতে ফিরে যাওযার।’ সূত্র: বিবিসি। সম্পাদনা : রিকু আমির